সুখের সন্ধানে – এক সাধ্বীর জীবন গাথা
এ আর সরকার
দূরে গাছগুলোর আড়াল দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অস্ত যাওয়া সূর্যটার দিকে তাকাতে তাকাতে ভুলে যাওয়া না চাওয়া সুদূর অতীতকে কাছে টেনে আনলেন সাধ্বী উপাসনা দেবী। একটু আগেই কিন্তু তিনি তাঁর এই আশ্রমের প্রবচনে বলছিলেন যে মানুষকে অতীত ভুলে বর্তমানেই জীবন কাটানো উচিত যদি সে দুঃখ থেকে মুক্ত থাকতে চায়। কারণ অতীত মানেই দুঃখ। অতীত দুঃখের হলে মন দুঃখে ভরে যায় আর অতি সুখের হলেও মন দুঃখী হয় কারণ বর্তমানের সুখ তুলনাতে কম পড়ে। কিন্তু অতীতকে ভোলা কি সত্যিই যায়? সমাজ কি বার বার চোখের সামনে আয়না ধরায় না?
“আমরা রেডি ম্যাডাম। আপনি বলুন।” মিডিয়ার একজন লোক উপাসনা দেবীর স্মৃতিচারণে বাধা দিয়ে ফেলল। “ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু মনে পড়ে সবই বলুন। ঘটনার সময় আগে পেছনে হলেও ক্ষতি নেই। বলুন।”
উপাসনা দেবী অনেক দিন ধরে মিডিয়ার লোকেদের এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আজ স্থানীয় একজন অতি বড় শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তির অনুরোধে তিনি ‘না’ করতে পারেননি।
অনেকগুলো ক্যামেরা চলছে। আশ্রমের বাগানের এক কোণাতে উপাসনা দেবীর সামনে সাজানো টেবিলটার ওপর অনেকগুলো মাইক রাখা। মাঝখানে যাতে বিঘ্ন না ঘটে তার জন্যে লাইটগুলো তারা প্রথম থেকেই জ্বালিয়ে রেখেছে।
শান্ত মুখ, উজ্জ্বল চোখ আর স্থির অভিব্যাক্তির সাথে উপাসনা দেবী কখনো থেমে থেমে কখনো সাবলীল ভাবে বলে চললেন তাঁর নিজের জীবন গাথা। অনেক বার উপস্থিত অনেকের চোখে অনায়াসে জল এল বটে কিন্তু উপাসনা দেবী নিজের অনুভূতি ব্যাক্ত করতে একটুও বিচলিত হলেন না।
পরের দিন প্রায় সব টিভি চ্যানেল তাদের বিশেষ প্রোগ্রামে উপাসনা দেবী বর্ণিত মর্মস্পর্শী আখ্যানের বিশেষ কোন কোন অংশকে বার বার বিজ্ঞাপনের আগে ও পরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান ভাবে দেখাল বটে কিন্তু কয়েকটা খবরের কাগজ তাদের বিশেষ গল্পের পাতায় সংক্ষিপ্তভাবে উপাসনা দেবীর বলা কাহিনীর প্রায় পুরোটাই ছেপেছিল।
উপাসনা দেবীর আসল নাম ছিল নির্মল কৌর। জাতিতে উচ্চবর্ণ সিখ। পড়াশুনায় সাধারণ গ্র্যাজুয়েট নির্মলের ছোটবেলা খুবই আদরে কেটেছিল। তারপর আজ থেকে ২৭ বছর আগে মা বাবার একমাত্র সন্তান ২৬ সে পা দেওয়া সেই নির্মল তার হরিয়ানার বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল বোম্বাই বেশ কিছু টাকা নিয়ে নায়িকা হওয়ার জন্যে। ঐ সময় অনেকেই এভাবে আসতো এবং আজও আসে।
পৌঁছুতেই এক বান্ধবীর মারফৎ নির্মলের পরিচয় হল এক মাঝবয়সী লোকের সাথে। ও নাকি বড় বড় ফিল্ম কোম্পানিতে কাস্টিঙের কাজ করে। অনেক ছেলে মেয়েকে কাজ পাইয়ে দিয়েছে সে। কয়েকজন তো ছোট বাজেটের ছবিতে নায়ক নায়িকাও হয়েছে। কতকগুলো সি গ্রেডের অ্যাডাল্ট সিনেমার নামও বলে দিল। বড় একটা এ্যালবাম খুলে অনেক মেয়ের হট ফটো আর কিছু সিনেমার পোস্টারও দেখাল দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া এক পুরনো ম্যাগাজিন থেকে। গুগল আর মোবাইল ফোন তো তখন ছিল না তাই ওইগুলোতেই যথেষ্ট বিশ্বাস হয়ে যেত। নির্মলেরও তাই হল। আনন্দে ও উৎসাহে নির্মল বলে উঠল, “তাহলে আমি চান্স পেয়ে যাবো?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু, ”
“’কিন্তু’ কি?”
“এইরকম কিছু ফটো তুলে একটা ছোট এ্যালবাম বানিয়ে আমাকে দিতে হবে।”
“অতো খোলাখুলি ফটো আমি দিতে পারবো না।”
“তাহলে নর্মাল ফটো-সেশান করতে হবে। ৫ হাজার লাগবে এ্যালবাম সমেত।”
“পাঁচ হা-জা-র! সত্তর আশি টাকাতে তো ফটো হয়ে যায় – বোধ – হয়।”
“ওগুলো চলবে না। কস্টিউম আর মেকআপ চাই। প্রফেশনাল ফটো।”
“আচ্ছা। তাহলে দেব আমি – পাঁচ হাজার।” একটু ভেবে আমতা আমতা করে বলল নির্মল।
এর পরের ঘটনা কিন্তু আরও আশ্চর্যের ছিল নির্মলের কাছে। ফটো-সেশান করানোর সময় তার কানে ঢোকানো হল দুটো কথা। এক – ছেলেদের যত ট্যালেন্টই থাকুক না কেন সোজা হিরো হতে হলে টাকা দিতে হয়। দুই – মেয়েদের ক্ষেত্রে হয় ‘কম্প্রোমাইজ’ করতে হয় নাহলে সমপরিমাণ টাকা দিতে হয়। অবশ্য আজকের দিনেও তাই হচ্ছে তবে ‘মি টু’ আসার পর থেকে প্রকাশ্যে নয় – অতি গোপনে। বলা বাহুল্য এখনকার মেয়েরা অনেক বেশী স্মার্ট এবং তাদের বেশীর ভাগই ‘দেওয়া নেওয়া’র ব্যাপারটা ভাল করে বোঝে। সেই জন্যেই ফিল্ম, টিভি, কর্পোরেট সব জায়গাতে ‘গিভ এন্ড টেক’ ঢুকে পড়েছে। না চাইতে বৃষ্টি যদি এসে যায় তাহলে একটু ভেজার মজা নিতে মানা কোথায়? অর্থাৎ, তুমি নও তো হাজার তোমার পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চস্থানে পৌঁছে তুমিই তো বলবে – আমি কখনও ‘কম্প্রোমাইজ’ করিনি। নিজের ট্যালেন্ট এর জোরে এখান পর্যন্ত এসেছি। তুমিই তো তখন অন্যের জন্যে ‘আদর্শবাদী’ হয়ে যাবে। সমাজ যখন বদলাচ্ছে ব্যবস্থাতো বদলাবেই।
বাধ্য হয়ে কম্প্রোমাইজ করতে নারাজ নির্মল নায়িকা হওয়ার অদম্য ইচ্ছায় হাত খরচের কিছু টাকা রেখে বাকি সব সমর্পণ করলো লোকটার হাতে। টাকার পরিমাণ কম হলেও নিশ্চিত কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকটা বিদেয় নিয়েছিল নির্মলের কাছ থেকে। পরে আর কখনও নির্মল তার দেখা পায়নি। যে অফিস দেখিয়ে টাকাটা নিয়েছিল সেখানে যেতে ওরা বলল, “অনেকেই এভাবে ছেলে এবং মেয়েদের ফটো এলবাম নিয়ে আসে। আমরা কারোরই কোন রেকর্ড রাখি না।”
“কিন্তু আপনাদের একজন তো বলেছিলেন আমায় কাজ দেবেন। নায়িকার রোল। তিনি নাকি ডিরেক্টর।” বিহ্বলতার সুর নির্মলের গলায়।
“নায়িকার রোল! হা হা হা। আপনাকে? বোম্বেতে হঠাৎ নায়িকার অভাব হয়ে গেল নাকি? দেখুন, এখানে সারাদিনে অনেক লোক আসে যায়। কেউ যদি বাইরে দাঁড়িয়ে বলে ‘এই অফিসটা আমার, আমি ডিরেক্টর’, আপনার কি তা বিশ্বাস করা উচিত?… আমরা আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনি পুলিসের কাছে যেতে পারেন। এখন আসুন। ধন্যবাদ।”
নির্মল জেনে গেছিল পুলিসে গিয়ে কিছু লাভ হবে না। ওর বান্ধবীও তাই বোঝাল।
স্নানাহার বন্দ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু কেঁদেছিল নির্মল পুরো এক দিন।
রাতের পর যেমন ভোর দুঃখের পর তেমন সুখ।
দু বেলা দু মুঠো খেয়ে পুরনো কাপড়ে শেয়ারিং ফ্ল্যাটে থেকে নির্মল যখন সংঘর্ষ করছিল ফিল্মের অফিসগুলোতে ঘুরে ঘুরে তখন তার জীবনে এল একজন পুরুষ – সুরেশ শ্রীবাস্তব। টিভি এবং ফিল্মে ছোট ছোট কাজ করে ভালো টাকা আয় করতো এবং ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে স্বাধীন ভাবে থাকতো সে। প্রথমে টাকা দিয়ে সাহায্য করল সুরেশ নির্মলকে। পরে খুব অমায়িকভাবে ডাকাতে নির্মল তার ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া করতে লাগল। খুব ছোট ছোট অভিনয়ের কয়েকটা কাজ ও তাকে পাইয়ে দিল সুরেশ। নির্মলের মনের মাঝে তার জায়গা হল। তারপর এক আবেগপূর্ণ সন্ধ্যায় বিশ্বাসের গভীরে নির্মল নিজেকে সঁপে দিল তার বাহুপাশে।
মাস খানিক পরে অডিশন দিয়ে যে দিন একটা টিভি শো’তে ভালো রোল পেল নির্মল ঠিক সেদিনই জানতে পারল তার শরীরের মধ্যে আর একটি প্রানের আগমন হয়েছে। আনন্দ আর দুঃখ মিশে যেন একাকার। আর সমাজ?
“ হ্যাঁ, তাই তো বলছি। এবরশন করিয়ে নাও। দস দিন পরে শুটিং। তত দিনে একদম ঠিক হয়ে যাবে। এ সুযোগ বার বার আসবে না।” কোনোরকম ইতস্তত না করেই বলল সুরেশ।
মনে খুব উচ্চাশা থাকলে মানুষ ছোট ছোট প্রাপ্তিকে গণনার মধ্যে আনতে চায়না। অবান্তর ভাবে নির্মলের যেন মনে হল গোলাপ গাছটা বাঁচাতে হলে আগাছাটাকে উপড়োতে হবে।
কিন্তু কার নিয়তি কি ছিল?
এবরশনের পর খবর পেল নির্মল টিভি শোটা বাতিল হয়ে গেছে। শুটিং আর হবে না।
সুরেশ আর তার জীবনে নেই। কিন্তু তবুও নির্মলের জীবন কেমন যেন গ্লানিময় হয়ে উঠল।
এমন সময় অভীক বাজাজ এসে দাঁড়াল নির্মলের পাশে। পরিচিতি অবশ্য একটু ছিল আগে থেকেই। নির্মল সব দুঃখ গ্লানি ভুলে আবার সুখের সন্ধানে জুটল। ভাল লাগা, ভালবাসা আর বিয়ে যেন মায়াবী সাপের মতো সর সর করে গিয়ে নির্মলের সুখের থলিতে ঢুকে পড়ল।
বম্বে তখন ‘মুম্বাই’ হয়ে গেছে। পেজার আর মোবাইল ফোন চালু হয়ে গেছে। অবশ্য যদিও তখন খুবই ব্যয়বহুল ছিল মোবাইল ফোন তবুও অভীক একটা ফোন কিনে নিল। ঠিক মনে নেই নির্মলের তবে অনেক দাম ছিল। ফোনের ভাড়া লাগতো। কল শুনতেও অনেক টাকা লাগতো করতে তো অনেক বেশী। ফোন কেনার আগে হাল্কা ভাবে ‘না’ যদিও একবার বলেছিল নির্মল কিন্তু তার নিজেরই খুব গর্ব হচ্ছিল যে তার স্বামী মোবাইল কিনবে। ওটা তখন একটা বিরাট স্ট্যাটাসের ব্যাপার।
নতুন নামের ঐতিহ্যময় এই পুরনো নগরীটাতে নির্মল বাজাজের দিন ভালই কাটতে লাগল। বাজাজ পদবীটা কেমন যেন বেশ ভারী ভরকম মনে হতে থাকল গর্ভবতী নির্মলের। ছেলে হলেও সম্মান পাবে মেয়ে হলেও – স্কুলে কলেজে সব জায়গায়। কিন্তু কি হবে? ছেলে না মেয়ে?
ভাগ্য তাকে ছেলেই দিয়েছিল। মুখের গড়নটা অনেকখানি ম্যায়েরই মতো। আনন্দে বুক যখন ভরে যাচ্ছিল নির্মলের অভীক বাজাজ তখন পা দিল অন্য রাস্তায়। খলনায়কের চরিত্র করতে করতে বোধহয় নিজেকে ওই ছাঁচে ঢেলে ফেলেছিল সে। মনোবিজ্ঞান অবশ্য এই যুক্তি সমর্থন করে।
রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে অকারণে ঝগড়া সুরু করে দিত অভীক। মাঝে মাঝে এক এক রাতে নতুন নতুন যুবতীরা নেশা করে তাকে বাড়ী পৌঁছুতে আসতো। ওর আয়ের টাকা যে কোথায় যেতে থাকল তা নির্মল বুঝতে পারল না। ক্রমশঃ ফোন গেল, গাড়ী গেল – বড় ফ্ল্যাট থেকে ছোট ফ্ল্যাটে এসে গেল – বাচ্চার দুধের পয়সাও কম পড়তে লাগল। শেষে অভীকের অভিনয়ের কাজটাও চলে যাওয়াতে রীতিমত ঘরেই অভিনয় করতে সুরু করল সে।
নির্মলের আর ধৈর্য থাকে না। ছেলে তার প্রাণ। তার জন্যে কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না সে এমন এক রাতে অভীক এক মেয়েকে এনে হঠাৎ বলে বসল ও তাকে বিয়ে করতে চায়। না – নির্মল একটুও আশ্চর্য হয়নি সেদিন।
ছেলের দিকে তাকিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ডিভোর্স পেপারে সই দিল নির্মল ঠিক পরের দিন। নিজের আত্মমর্যাদা পুরোটা বজায় রেখে কোন টাকা পয়সা দাবী না করে কোর্টের অর্ডারের অপেক্ষায় না থেকে শুধু ছেলেকে নিয়েই আলাদা হয়েছিল নির্মল।
মেয়ের এই দুর্দশাতে এবার পাশে এসে দাঁড়াল স্বয়ং নির্মলের মা। ওর বাবাও এসেছিল বটে কিন্তু দিন কয়েক থেকেই কিছু টাকা মেয়ের হাতে দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল সে মেয়ের অতি ছোট ভাড়ার ঘরটা থেকে।
নাতিকে দিদার কাছে রেখে এক দিন দু দিনের শুটিঙে এখন যেতে পারতো নির্মল। নদীতে জোয়ার আর ভাটার ঠিক মাঝখানের থমথমে ভাবের মতো সময় ছিল যেন নির্মলের এই দিনগুলো। না সুঃখ না দুঃখ। কিন্তু বাড়ি ফিরে ছেলেকে কোলে নিয়ে আর মা’কে দেখে নির্মলের যেন মনে হতো জীবনে আর কোন কিছুরই তার দরকার নেই। এইই যথেষ্ট।
কিন্তু ভাগ্যে যে তার আরও অনেক কিছু লেখা ছিল। বোধহয় অনেক সুখ আর আরও অনেক কিছু।
মাস তিনেক পর মাত্র দু দিনের আলাপে নির্মল এবং তার মায়ের মন জয় করে নিল উত্তরবঙ্গে জন্ম ও প্রতিপালিত টুকটুকে ফর্সা সুন্দর অবিবাহিত চল্লিশের কাঠগড়ায় পা দিতে যাওয়া মুম্বাইয়ের প্রবাসী বাঙ্গালী ব্যবসায়ী অনিন্দ কাঞ্জিলাল। অনিন্দ’ই প্রথম আলাপ জমিয়েছিল নির্মলের সাথে শুটিঙয়ের বিরতির সময়। ও নাকি নির্মলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেছিল। নির্মলের ছেলেকে সে নতুন বাবার নাম দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ফেলেছিল আবেগে।
মেলামেশা এত দ্রুত এবং এতটা এগিয়ে গেছিল যে নির্মলের মা ওকে অনিন্দের হাতে সঁপে স্বামীর একাকীত্ব দূর করতে নিজের বাড়ি চলে গেল। বিদায়ের বেলাতে অতি শান্ত ছোট্ট শিশুটি দিদার কোল থেকে মায়ের কোলে এসে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে একবার দিদাকে আর একবার হবু বাবাকে দেখেছিল। দিদার চোখের জলের ভাষা ওই ছোট্ট শিশু মন বুঝত কি করে? আর কি করেই বা বুঝত নতুন বাবার অমায়িক হাসির গভীরে কঠোরতা আর ঘৃণার এক বিশাল ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে কিনা।
আমাদের সমাজে স্ত্রী পুরুষের সঙ্গ পেতে চায়। বাহ্যিক কারণ যা’ই থাকুক না কেন প্রায় সব জায়গায় সুনিশ্চিত ভাবে শরীরই একমাত্র আন্তরিক কারণ। বিজ্ঞানের ভাষায় ‘হরমোন’ বললে মোটেও ভুল হবে না। আর পুরুষ? তার কি? হরমোন তার কোথায় কোথায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে? প্রত্যেক প্রাপ্তির পর তাদের ‘আমিত্ব’ জেগে ওঠে ‘গর্ব’ আর ‘অহংকার’ নিয়ে। অহংকার জন্ম দেয় ঘৃণাকে আর ঘৃণা জন্ম দেয় অদম্য ক্রোধকে। আর ক্রোধাগ্নি দাবানলের চাইতেও ভয়ঙ্কর। সমস্ত জীবন, পরিবার ও সমাজ কে জ্বালিয়ে দিতে পারে। ‘পারে’ না, দেয়।
তাইই হোল নির্মলের ক্ষেত্রে। নির্মলকে মাত্র মাসের দুয়েকের মতো শয্যা-সঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার পর অনিন্দ কাঞ্জিলালের ‘আমিত্ব’ উঠল জেগে। ওর মনে হল ও নির্মলকে আশ্রয় দিয়েছে মাত্র। ‘অনিন্দ কাঞ্জিলাল’এর কাছে তো এরকম অনেক অভিনেত্রী আসে যায়। এদের কি চরিত্র? এই ছেলে কার? আদৌ কি নির্মল জানে তার আসল বাপ কে?
রোজ ঝগড়া, মারামারি আর তারপর একটুখানি নকল ভালবাসা চলতে থাকল আরও কয়েয়েকদিন। তারপর নির্মলের সুখের নৌকো দুঃখের সমুদ্রের করাল গ্রাস থেকে আর মুক্তি পেল না।
এক রাতে মদের নেশায় নির্মমভাবে বেল্ট দিয়ে নির্মলকে মারতে থাকে অনিন্দ। বিছানার চাদরে হ্যাঁচকা টান পড়াতে ঘুমন্ত জ্বরগ্রস্ত বাচ্চাটা ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশের ভাঙা লাইট স্ট্যান্ডটার ওপর। অনিন্দ-রুপী মাতাল পশুটার হুঙ্কার আর নিরপরাধ দুর্বল অসহায় নির্মলের কাতর প্রার্থনার মাঝে শোনা গেল ছোট্ট শিশুটির ক্ষীণ এক আর্তনাদ। তারপর সব নিস্তব্ধ। সব শেষ।
* * *
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল নির্মলের অবিবাহিত এক পুরুষের সাথে থেকে তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করার অপরাধে।
জেলের ভেতর সারা সারা দিন নির্মল ডুবে থাকত গভীর ধ্যানে। চাওয়া পাওয়ার হিসেব সব শূন্য করে ফেলেছিল সে। স্বামী বিবেকানন্দের রচনা সমগ্র বার বার পড়তে পড়তে সুখ-দুঃখ, মান- অপমান সব এক হয়ে গেছিল। ক্রোধ, লোভ, মোহ সমেত ষড়রিপুর সবগুলোই তার শরীর ও মনের অনেক বাইরে চলে গেছিল। নির্মল কৌর যেন প্রতক্ষ মারা গেছিল। আর তার শরীরে যেন অন্য কোন শান্ত আত্মা ঘর করে নিয়েছিল। বছর পাঁচেক পরই সবাই তাকে উপাসনা দেবীর নাম দিয়ে দিয়েছিল। অনেক শিষ্যও হয়ে গেছিল তার। অনেক অপরাধীকে শুধরেও দিয়েছিল সে।
রেহা হওয়ার আগে জেলের বন্ধ কুঠুরি আর বন্দীদের জগত থেকে বেরিয়ে বাইরের জগত দেখতে পেয়েছিল নির্মল মাত্র দু বার। একবার বাবার অকাল মৃত্যুতে আর দ্বিতীয়বার আরও বছর দুয়েক বাদে মায়ের মৃত্যুতে। মায়ের চিতাতেই তার ছিল শেষ অশ্রুবিসর্জন।
১৪ বছরের সাজা কাটার পর এক নতুন জীবন, শুদ্ধ শরীর ও মন নিয়ে জেল থেকে রেহা হলেন বর্তমানের উপাসনা দেবী।
কিন্তু ভারত আমাদের দেশ। অনেক প্রশ্ন, অনেক মন্তব্য। আমরা সমালোচনা ছাড়া যেন আর কিছুই জানি না। আমরা ভুলে গেছি রামায়নের রত্নাকর আর গৌতম বুদ্ধের অঙ্গুলিমালের কাহিনী। আমরা সবার পরীক্ষা চাই। পূর্ণ প্রমাণ চাই।
তাই উপাসনা দেবী মিডিয়ার সামনে সব বললেন। দেশবাসীর জানা অজানা সব। কোনও গুরু তাঁর নেই তবে তিনি স্বামী বিবেকানন্দকেই এক প্রকৃত গুরু বলে মনে করেন। অথচ অন্য কারোর প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধও নন।
তাঁর বিশেষ বানী কি জানতে চাইলে তিনি বললেন, “ আমি স্বামী বিবেকানন্দের কথাই নিজের ভাষাতে বলবো – সুখের পরে আসে দুঃখ তারপর আবার সুখ; তারা একে অন্যকে অনুসরণ করে। আমরা যা চাই তা হল শুধু সুখ, দুঃখ কখনও নয়। এটা ভুলে যাই যে আমাদের মন সুখদুঃখের শিকল দিয়ে বাঁধা। আর এ দুটো শুধু আমাদের অনুভূতি মাত্র। দুটোকে এক বলে অনুভব করলে আর কষ্ট থাকবে না।”
“আপনার কোন মন্ত্র আছে কি?”
আছে। খুব সরল। তবে ঠিক মন্ত্র বললে ভুল হবে। এটা একটা চেতনা। ‘সৎ চিন্তা, সৎ বুদ্ধি, সৎ কর্ম’। মনের মাঝে যে ‘চিন্তা’ অর্থাৎ ‘ধারণা’ আসে, আর তা কর্মে পরিণত করতে গেলে যে বুদ্ধির দরকার হয় আর সেই বুদ্ধির দ্বারা কৃত কর্ম সবই যেন সৎ অর্থাৎ শুদ্ধ হয়। তাহলে আর কখনও দুঃখ থাকবে না। গৌতম বুদ্ধ ও তাই বলেছেন।”
সবার চলে যাওয়ার পর ধ্যানে বসেছিলেন উপাসনা দেবী। কোথাও যেন একটা অতি তুচ্ছ দাগ থেকে গিয়েছিল মনের মাঝে। আজ তা মুছে গেল চিরতরে।
সমাপ্ত
অসাধারণ 😊
Thank you so much
Anek anek bhalo galpa balar vangima o bhalo besh besh bhalo legeche
পাঠকের ভালো লাগাই আমার সাফল্য।
Thank you so much.
খুব খুব খুব সুন্দর 👏🏻👏🏻👏🏻👏🏻
পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল….
পাঠকের ভালো লাগাই আমার সাফল্য।
Thank you so much.
খুব সুন্দর হয়েছে । বাস্তবের সাথে এতটাই মিল যে মনে দাগ কেটে দিল।
Thank you very much.