(ধারাবাহিক উপন্যাস)
দামুর বাবা অপাহিজ হরিরাম পোদ্দারের আরও নানান অসুখের জন্যে তার স্ত্রী রাইমনি স্বামীকেই দায়ী বলে মনে করে। এমন সময়ে দামুকে বাড়ি ঢুকতে দেখে রাইমনি খুব রেগে গিয়ে ছেলেকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দেয়। দামুও এক বিদ্রোহির মত বলে ওঠে যে সে ইঁটভাটাতে কাজ বন্দ করিয়ে দেবে। তবেই মালিক বকায়া বেতন দিতে বাধ্য হবে।
ওদিকে ইঁটভাটাতে অল্প কয়েকজন মজদুর কাজ বন্দ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। মুনিম তাদের মনোভাব বুঝে তাদের কামচোর বলে ধমক দিতে যায় এমন সময় ইঁটভাটার মালিক রত্নাকর সিংহ ভাটার পরিসরে ঢুকে পড়ে। দামুর বিধবা দিদি সন্ধ্যার সাথে তার ধাক্কা লাগে আর বিহ্বল হয়ে সে তার এখনও বাঁচিয়ে রাখা যৌবনকে দেখতে থাকে।
এর আগে –
তৃতীয় পর্ব
ক্রোধ, মোহ আর ভালোবাসা
নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং চাটুকারিতায় ভরা এই টিপ্পনীর জবাবে মাথা নিচু করে আমতা আমতা করল রামদীন। “ আজ্ঞে – ওই – ”
“হ্যাঁ – হ্যাঁ, বল -বল ”
সবাইকে হতচকিত করে বনবারীর প্রতি হাতের ইশারা করে ঘাড় বাঁকিয়ে চোর চোখে বাক্য পুরো করল রামদীন, “ ওই – কাকা বলছিল – তার খুব কষ্ট – তাই কাকাই – ”
দুম করে রত্নাকর নিজ চরিত্র প্রদর্শন করে হুংকার ছেড়ে বলল, “ আরে কষ্ট কার নেই? আমি এই ইট ভাটার মালিক। আমারও কত কষ্ট। তাই বলে আমি কি ইট ভাঁটা বন্ধ করে দেব? – কিরে বুড়ো? বুড়ো বয়সে নেতাগিরির সখ চেপেছে? অ্যাঁ?”
বনবারীর বিনম্র উত্তর, “না মালিক, নেতাগিরি তো বড়লোকের কাজ, যারা জোর জবরদস্তিও জানে আর ধোঁকাবাজিও। আমরা গরীব। দু’বেলার ভাতের জন্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেই জানি।”
“আরে চোপ – শালা, ভাষণ দিস না। সিধা সিধা বল কি বলতে চাস?”
“মালিক, মাইনে চাই। অনেক দিন হয়ে গেছে। সবার ঘরে – ”
“কতদিন? বছর তো হয়নি না?”
হঠাৎ ফোড়ন কাটল এতক্ষণ চুপ থেকে মাথা নাড়ানো মুনিম, “সেটাই তো আমি বলছিলাম মালিক। মাথায় ঢোকাচ্ছিলাম এই কামচোরদের।”
“ব্যস-ব্যস – অনেক ঢুকিয়েছ তুমি মুনিম। এবারে আমি এদের মাথা সাফ করবো। শোন তোরা সব – মাইনে আমি দেবো আমার মর্জি মতন। যারা কাজ করবি কর নাহলে দফা হয়ে যা। আমি দূর গাঁ থেকে লোক নিয়ে আসবো। তারা এখানে থেকে কাজ করবে। মাল বিক্রি করে মাইনে দেবো বললেও ওরা রাজী হয়ে যাবে। আরে অকৃতজ্ঞের দল – আমি তোদের উপকার করছি কাজে রেখে আর তোরা শালা মাথায় চড়ে বসতে চাইছিস? ছিঃ!”
নিজের এই গরম ভাষণের প্রতীক্ষিত নরম প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে নীরব শ্রোতাদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার ঝাঁঝাল হাত নাড়িয়ে রত্নাকর, “চল – যারা কাজ করতে চাস না তারা বেরিয়ে যা। পয়সা কড়ির হিসেব সামনের মাসের শেষে এসে বুঝে নিবি। রত্নাকর সিংহের কাছে সব সমস্যার সমাধান আছে। চল – চল।”
আশাবাদী গরীব শ্রমিকরা কাজ হারাতে না চেয়ে গুটি গুটি করে সব নিজের নিজের জায়গায় ফিরে গেল। বলা বাহুল্য রামদীন ইতিপূর্বেই স্বার্থপরতার শুষ্ক হাসি হেসে কেটে পড়েছিল। বনবারী আর জুবেদ একে অপরের দিকে চোখ চাওয়া-চাই করে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম শ্রমিক মাথা নিচু করে রত্নাকর আর মুনিমের সামনে দিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, “ক’টাদিন আরও যাক। ভগবান সব দেখছে।”
বিনা প্রয়াসেই টিপ্পনী বেরিয়ে এল রত্নাকরের মুখ থেকে, “হুঁ, ভগবান দেখছে। আরে ভগবান যদি দেখত তাহলে তোকে দিয়ে বাবুগিরি করিয়ে নিত না?”
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে টুকু ঠিক মতো দিতে পেরে সন্তুষ্টিতে অট্টহাসি হেসে এখনও দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনের দিকে তাকাল রত্নাকর। “কিরে? তোদের চর্বি এখনও গরম রয়েছে দেখছি?”
বনবারীর আকুতি, “মালিক, অল্প কয়েকটা টাকা দিলে আপনার কোন পার্থক্য পড়বে না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তেল-নুনের যোগাড় হয়ে যাবে মালিক।”
জুবেদের সমর্থন এল, “হ্যাঁ মালিক, অন্তত: একটা সপ্তাহের পয়সা দিয়ে দিন। সপ্তাহে সপ্তাহে পয়সা দেওয়ার কথা হয়েছিল।”
রত্নাকরের চোখদুটো যেন হঠাৎ জ্বলে উঠল। কিন্তু ভাব প্রকাশ হতে না দিয়ে বলল, “আচ্ছা – ঠিক আছে। অফিস ঘরে আয়। সেখানে কথা বলবো।” বলেই ইটের ছোট ছোট টুকরো আর ছাই মাটি ফেলে তৈরি করা সঙ্কীর্ণ রাস্তা দিয়ে সটান অফিস ঘরের দিকে চলে গেল।
মুনিম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ইশারাতে দুজনকে যেতে বলে নিজে কাজের তদারকির জন্য অন্যদিকে চলে গেল। বনবারী আর জুবেদ বড় আশা নিয়ে এগিয়ে চলল অফিস ঘরের দিকে।
***
পাকা ইটের থাক দিয়ে বানানো অফিস ঘরের মেঝেটা মাটির লেপ দেওয়া। তক্তপোশের ওপর গদি আর আরাম করে বসার জন্যে দুটো কোল বালিশ। ব্যাটারিওয়ালা একটা টিভি একটি ভিডিও প্লেয়ারের সাথে খাটের আড়া ধারে এমন করে রাখা যাতে কেউ খাটের পাশে এক বিশেষ জায়গায় এসেই টিভিটা দেখতে পাবে। খাটের এক কোনাতে রাখা তালা দেওয়া এক বাক্স আর লাল কাপড়ের জিলদ বাঁধা এক মোটা বহি খাতা । অনতিদূরে একমাত্র কাঠের টুল দেখে বোঝা যায় বহিরাগতদের জন্য বসবার কোন ব্যবস্থা স্বেচ্ছাকৃতভাবে করা হয়নি।
খাটের কানায় বসে রাগে পা নাড়াচ্ছিল রত্নাকর। জুবেদ এসে দাঁড়াতেই বনবারী ঢুকল। তাদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিমেষে উঠে দাঁড়িয়ে রত্নাকর “তোদের পয়সা চাই না? এই নে –এই নে” বলে ঠাস ঠাস করে দুজনের গালে আচমকা দুটো ভারী থাপ্পড় কষল। পয়সা পাওয়ার ইচ্ছের বিনিময়ে হঠাৎ পাওয়া এই আঘাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দুই শ্রমিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুকফাটা হাহুতাস তাদের অশ্রু বিন্দু হয়ে চোখের কোনে দেখা দিল। রত্নাকরের রোষ তবুও কম হল না। একনাগাড়ে বলে চলল সে, “ এটা যদি আমি সবার সামনে করতাম তাহলে কি তোদের সম্মান থাকতো? আরে পয়সা যখন পাস, তখন জমা কেন করিস না? আমি ব্যবসা করি, কোন দানছত্র খুলিনি। চল যা – কাজ কর।”
বনবারীর মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ব্যথিত বেদন বেরুল, “ চল, জুবেদ ভাই। এই কলসি ও একদিন ভাঙবে।”
“ কি বললি? আমি পাপের কলসি? ভাঙবি, তুই?” বলে আবার মারার জন্যে রত্নাকর হাত ওঠাতেই মাঝখানে এল জুবেদ।
করজোড়ে বিনতি তার, “ এই বয়সে এটাই যথেষ্ট, মালিক। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক।”
“চল, বেরো। মঙ্গলই হবে।” হাত নাড়িয়ে বিদেয় হতে বলাতে অর্থক্লেশ এবং অপমানে জর্জরিত নিরুপায় শ্রমিক দুটি নতমস্তক অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে কর্মস্থলে ফিরে এল।
থাক ইট মাথায় সন্ধ্যাকে দেখে ডাকল জুবেদ। কাছে এসে সরল সন্ধ্যার প্রশ্ন, “কি হয়েছে চাচা?”
“না, কিছু না। দামুকে দেখি না যে কাল থেকে? ও থাকলে বোধহয় এরকমটা হত না।”
বনবারী যোগ দেয় বিমর্ষ ভাবে। “দামোদর কি কাজ ছেড়ে দিল?”
“না, কাকা। সকালে তো ভাই বেরিয়ে এসেছিল। মর্জির মালিক। কোথায় যে আছে, কি যে করছে ভগবান জানে।” বনবারী আর জুবেদের অন্যদিকে চলে যাওয়ায় নিজের মনে শেষ কথাগুলো বলতে বলতে চলতে থাকল সন্ধ্যা।
***
রাগে ও দুঃখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অভ্যেস বশতঃ বট গাছের নিচে এসে বসেছিল দামু। নিদ্রাবিহীন অশান্ত এবং ক্লান্ত দেহটা গাছে এলিয়ে দিয়ে পূজাকে নিয়ে নানান কথা ভাবতে ভাবতে সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ধীরে ধীরে তার চোখে ঘুম জড়িয়ে এল।
***
নিজের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির বাইরের ঘরে পূজার ক্রোধ মিশ্রিত চাপা কণ্ঠস্বর, “ না, কক্ষনো না।”
সামনে দাঁড়িয়ে তিরিশ উর্ধ বিল্টন সিংহ তার অন্যায় এবং কদর্য প্রস্তাবের নাকারাত্মক জবাব শুনেও পিছপা না হয়ে চাপা গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল, “ কেন ‘না’? আমি এত খারাপ তো নই। তুমি হ্যাঁ বলে দাও নাহলে – ”
এবারে পূজার কণ্ঠস্বরে বাঁধন নেই। “ নাহলে? বদনাম করবি তুই আমায়?”
“না-না, তা নয়,” বলে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ভেতর থেকে পূজার বাপ বদ্রীপ্রসাদ বেরিয়ে আসাতে পুরনো প্রসঙ্গ কেটে দাঁত বার করে ছোট্ট করে ‘নমস্তে’ করল বিল্টন। বদ্রীর খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ির ভারী মুখের সাথে সকাল সকাল চড়ানো মদের প্রতিক্রিয়াস্বরুপ তার লাল লাল চোখদুটো যেন বিল্টনের দেওয়া ‘মাতাল’ উপাধিটাকে পরিপুষ্ট করছিল। ষাট উর্ধ বদ্রী বিল্টনকে আপ্যায়ন করে বসতে বলে টাল সামলে নিজেই প্রথমে বসে পড়ল নিজের জন্যে বিশেষ করে বানানো কাঠের চেয়ারটাতে। অবস্থা ভাল বুঝে গদ গদ হয়ে বিল্টন দ্বিতীয়বার বলে উঠল, “ আঙ্কেল, নমস্তে।”
প্রথমবারের ‘নমস্তে’ টা এবারের সাথে যৌথ হয়ে বোধহয় বদ্রীর কানে ঢুকল। “হ্যাঁ-হ্যাঁ, বস বাবা। দাঁড়িয়ে কেন?”
ট্যাড়া করে পূজার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে করে একটু আঁচু কাঁচু করল বিল্টন, “ হ্যাঁ – না – মানে – এখানে কারুর যদি খারাপ লাগে তাহলে?”
নির্বাক কিন্তু উত্তেজিত পূজার দিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিপাত করে বদ্রী বলল, “কার আবার খারাপ লাগবে? না-না। তুই যা – চা বানিয়ে আন।”
পা পটকে পূজা চলে গেলে পরে তার প্রতিক্রিয়াতে কোন নজর না দিয়ে বদ্রী বলল, “কি খবর বাবা?”
নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে বসতে ভূমিকা শুরু করল বিল্টন, “ আঙ্কেল, আমি আপনার সাথেই দেখা করতে এসেছি। কিছু মনে করবেন না। আপনি পূজার ঠিকমতো –”
শব্দকোষ থেকে সঠিক শব্দ না বাছতে পেরে হঠাৎই স্বভাব বশত বলে উঠল, “ ইউ নট কেয়ার – হ্যাঁ।”
ইংরেজির প্রতি এক অবিশ্বসনীয় দুর্বলতা থাকার দরুন এইরকম অশুদ্ধ ইংরেজিও বদ্রীকে অতিসন্তুষ্টি পাইয়ে দিত এবং বক্তার প্রতি তার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যেত। অজ্ঞতা স্বীকার না করে ঘুরিয়ে বলল, “একটু খুলে বল বাবা।”
“ওর বয়েসটার দিকে কোনদিন নজর দিয়েছেন? কতো – ”
“বুঝি বাবা – সব বুঝি। তিন বছর আগে এক সম্পর্ক এসেছিল। জানি না কি করে ওরা পাকা কথার পরেও না করে দিয়েছিল। তখন ওর মা ছিল। আমার একমাত্র ছেলে শহরেই বিয়ে করে ঘরজামাই থেকে গেল। এই দুঃখ সইতে না পেরে তার নানান অসুস্থতায় ভরা মা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল। আমার একা হয়ে যাওয়ার পরও আমি কয়েকবার বিয়ের কথা তুলেছিলাম পূজার কাছে কিন্তু সে প্রতিবার এড়িয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল –”
“আপনার মনে হয়েছিল – মেয়ে নিজের ঘরে রয়েছে তো খারাপ কি? একা থাকেন বলে স্নেহবশতঃ আর কিছুটা স্বার্থের খাতিরে আপনি একথা ভাবেন। নেশার ঘোরে থাকেন আঙ্কেল আপনি – আর ওদিকে -” বলে ইচ্ছাকৃত ভাবেই বক্র হাসি হেসে থামল বিল্টন।
খেই ধরে প্রশ্ন বদ্রীর, “ আর ওদিকে কি?”
“আর ওদিকে আপনার চাকরানীর ব্যাটা –” বাক্যাংশটা অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে বলে বদ্রীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে একটু থামতেই বদ্রীর কৌতূহলী প্রশ্ন এল, “কি হল তার?”
“না, তেমন কিছু না – ” ধূর্তামি ভরা চোখদুটো তার দপ দপ করে উঠল। “তাকে তো আমি টাইট করে দিয়েছি। হারামজাদা পূজার পেছনে লাইন মারছিল।” দাঁত চিবিয়ে নাটকীয় ভাবে কথাগুলো শোনাতে সে এত মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে নিজের জন্যে অনেক আগে বানিয়ে রাখা চায়ের কাপ সমেত ট্রেটা হাতে নিয়ে কখন যে পূজা ঢুকে পড়েছিল তার খেয়াল করতে পারল না।
ট্রে সুদ্ধু চায়ের কাপটা সামনের টেবিলে ঠকাস করে রেখে দিয়েই পূজা আজ নিডর হয়ে বিল্টনের বিরুদ্ধে অগ্নিবাক্য উচ্চারণ করল। “তুই নিজের হারামিপনা বলছিস না কেন? অপরের মা বোনের ওপর নজর দিয়ে দিয়ে ঘুরিস। জুয়াড়ি – থুঃ।”
মেয়ের এই অবাঞ্ছিত সত্য কথন সহ্য করতে না পেরে নড়বড়িয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বিল্টনের থামিয়ে দেওয়ার আগেই ঠাস করে পূজার গালে এক চড় কষল বদ্রী।
ফুঁপিয়ে কেঁদে পূজা যেন আজ মনের কথা বলতে চাইল। “আরও একটা চড় মারো। আমায় মেরে ফেল বাবা। কিন্তু একটা কথা জেনে নাও – দামুকে আমি ভালবাসি – হ্যাঁ, আমি।”
বিল্টনের কোঁচকানো চোখদুটো দিয়ে রাগ আর ঘৃণা যেন ফেটে পড়তে চাইল। বদ্রীর ক্রোধ আর বিস্ময়ে ভরা মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল পূজা তার শেষ বাক্যটা। “আর – বিয়ে আমি দামুর সাথেই করবো।”
এবারে বদ্রীর হাত ওঠার আগেই কিন্তু বিল্টন তার হাত ধরে ফেলল। “না, আঙ্কেল। ছেড়ে দিন। ও বোঝে না।”
“দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। নাক কাটিয়ে দিলি আমার।”
বাপের তিরস্কার শিরোধার্য করে সোজা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল পূজা।
ঠোঁট দুটোর একপাশ আর ভ্রু কুঁচকে ঝিম-ঝিম মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল বদ্রী। তার মাতাল মস্তিষ্ক বুঝতে পারল মেয়ের বিয়েটা কেন ভেঙ্গে গিয়েছিল আর কেন ও পরে এড়িয়ে যেত বিয়ের প্রসঙ্গকে।
সন্তুষ্টির কুটিল হাসি হেসে বিল্টন সামলায় বদ্রীকে। “আঙ্কেল, ভুলে যান। ওর এ সব মেয়েমানুষী কথা – দ্যাট ইজ রাইট। আমি কিছু মনে করিনি। আপনি বসুন।” বদ্রীকে হাত ধরে বসিয়ে বলে সে, “ আমি যে কিছু বলতে এসেছিলাম তা তো রয়েই গেল।”
বিল্টনের ওপর বদ্রীর অনেক বিশ্বাস। শুঁড়িখানার বন্ধুত্বে প্রথম প্রথম বিশ্বাসের বহর অনেক বেশীই হয়। মাতালকে মদ যোগালে তার বিশ্বাসভাজন হওয়া যে কত সহজ তা এখানে বিল্টন সিংহকে দেখলেই বোঝা যায়। সেই বিশ্বাসের কারণেই বদ্রী এখন অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে ধনাত্মক আবেগে জানতে চাইল বিল্টনের কথা।
বিল্টন আর সময় নষ্ট না করে চট করে বলে ফেলল, “আঙ্কেল, এই বদনামী থেকে বাঁচার একটাই রাস্তা। আর তা হল পূজার বিয়ে – কোন এক ভাল ছেলের সাথে।”
“কে করবে ওর সাথে বিয়ে?”
বদ্রীর নিরাশা ভরা প্রশ্নের জবাবে বিল্টন দ্বিধাহীন হয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিনম্রতার সাথে বলল, “আঙ্কেল, আপনি যদি আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন – আমি – ”
“তুমি করবে বিয়ে?” সন্তুষ্টিতে করজোড়ে প্রার্থনার ভঙ্গী করল বদ্রী।
“না, মানে – আপনি যদি আমায় পছন্দ করেন – ”
বিল্টনের ধূর্তামির বিন্দুবিসর্গ না জেনেই আবেগে গদ গদ হল বদ্রী। “বাবা, আমার দুঃখ তুমি দূর করলে। তুমিই আমার পছন্দ – আমার মেয়ের জন্যে।”
ধূর্তামির হাসি মুখে এনে অতি বিনম্র ভাব দেখিয়ে বদ্রীর পা ছুঁতে যায় বিল্টন।
আবেগপূর্ণ বদ্রীকে এবার যেন নেশাটা ঘিরে ধরল। “ ব্যস –ব্যস, বাবা। আমি তোমায় আশীর্বাদ করছি তোমরা সুখী হবে। আর এখন থেকেই আমরা শ্বশুর-জামাই বন্ধু।” বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠল বদ্রী।
চরম সফলতা অনুভব করে সমস্বরে হাসল বিল্টনও। কাল্পনিক খুশী বাঁটতে চাইল বদ্রী। তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল, “ তাহলে হয়ে যাক – এক এক পেগ। নিয়ে আসি ভেতর থেকে বোতলটা?”
“না আঙ্কেল –”
“আর আঙ্কেল নয়, আমাকে ‘শ্বশুরজী’ বল বাবা।”
“তাই হোক ‘শ্বশুরজী’। এখন তো আমি নেব না।” চোখে মুখে আসা দুষ্টতার ছাপকে সরলতায় বদলানোর চেষ্টা করে বলল বিল্টন, “চতুর সিংহের ‘আড্ডা’য় আসুন না – আজ। খুব জমবে ‘ইয়ারী’ যখন জুটবো আমি, আপনি আর বিলায়তি ‘রামপিয়ারি’।”
দুজনেই আবার হেসে উঠল। বদ্রী মদ পাওয়ার খুশীতে আর বিল্টন জিতে যাওয়ার খুশীতে।
বিহার, ইউ. পি. তে ট্রেনের মধ্যে এক স্পেশাল চা বিক্রি হত যাকে ওরা বলত ‘রামপিয়ারি’। সেই নামেরই অনুকরণে বিদেশী মদকে ওরা হাসিমাজাকে বলত ‘বিলায়তি রামপিয়ারি’। আর চতুর সিংহের ‘আড্ডা’ এক দেশী মদের বার যেখানে বাঈ-নাচের সাথে সাথে বেআইনিভাবে বিদেশী মদের ফোয়ারা চলত আর বলা বাহুল্য ওখানেই প্রথমবার ডেকে বিদেশী মদের স্বাদ চাখিয়েছিল বিল্টন দেশী বোতলে অভ্যস্ত বদ্রীকে।
“তাহলে এখন চলি আঙ্কেল – না মানে শ্বশুরজী।” চৌকাঠের বাইরে গিয়ে পেছন ফিরে না তাকিয়েই মুখ টিপে হেসে বিল্টন নিমন্ত্রণ দিল আর একবার, “আসবেন কিন্তু। আমি ওখানেই থাকবো।”
“আসবো, নিশ্চয়ই আসবো।” সমাজবিরুদ্ধ ভাবে হলেও মেয়ের বিয়ের পাকা কথায় আর মদের হবু এক পাকা সঙ্গী পাওয়ার আনন্দে নিজেকেই বোধহয় মাথা নেড়ে জবাব দিল জাতিতে ব্রাহ্মণ বদ্রী প্রসাদ পাণ্ডে।
***
বিকট এক দানবের রূপ ধরে যেন পূজাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বিল্টন কোন অজ্ঞাত ঠিকানায়। রাবণের হাতে পড়া সীতার ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চীৎকারের মতো পূজার সাহায্য প্রার্থনা শুনে তাকে বাঁচানোর জন্যে তীব্র বেগে ছুটতে ছুটতে নিজে পাথরের মতো কিছু একটাতে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তেই দুঃস্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল দামুর। চোখ মেলে চাইতেই পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল সে সূর্যটা প্রায় মাথার উপরে উঠে এসেছে। সাকারাত্মক মনের জোরে উঠে পড়তে চাইলেও তার নাকারাত্মক মন তাকে বসে থাকার আদেশ দিলে পরে বসে বসে বিমর্ষ ভাবে অতীত ভবিষ্যৎ মিলিয়ে অনেক কথাই ভাবতে লাগল সে।
দামুর ইচ্ছাশক্তির জোরেই হোক কিংবা পূজার নিজস্ব ইচ্ছাতেই হোক সে কিন্তু ইতিপূর্বেই গাছতলার ওপারটাতে পৌঁছে গেছিল। তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে ক্রমাগত ভেঙ্গে পড়া মন এখন দামুকে দেখে সতেজ হয়ে উঠল। মুখে হাসি এনে পা টিপে টিপে এগিয়ে দুষ্টুমির ছলে ছোট একটা নুড়ি পাথর উঠিয়ে দামুর পিঠে ছুঁড়ে মেরে চট করে গাছের পেছনে লুকোল সে। দামু পেছন ফিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে গাছের থেকে কিছু পড়েছে মনে করে আবার ঘুরে বসল। এবারে পূজা আর একটা নুড়ি পাথর উঠিয়ে ছুঁড়তেই সচেতন দামুর নিমেষে পেছন ফিরে তাকে দেখে ফেলাতে খিল খিল করে হেসে উঠে এগিয়ে গিয়ে দামুর পাশে বসল সে। দামুর শুকনো হাসির জবাবে প্রশ্ন করে উঠল সে, “কি হল? রাগ এখনও যায়নি?”
“তোমার ওপর রাগ নেই আমার।”
নকল করে কথাটা পুনরায় আওড়ে দামুর চিবুকটা নাড়িয়ে পূজা বলল, “ তাহলে ঝোলা মুখ কেন?”
দামুর মুখে আবার শুকনো হাসি দেখে নিজের দু’কান ধরে মাথা নেড়ে মুখ বানিয়ে বলে উঠল পূজা, “কালকের জন্যে আমায় ক্ষমা কর। আমি না ভয় পেয়ে গেছিলাম। সত্যি।”
“তুমি তো এত সহজে বলে দিলে ভয় পেয়ে গেছিলে। আর আমি রাতে না ঘুমোতে পেরেছি আর না জাগতে পেরেছি। কাজেও গেলাম না।”
“কেন? কেন গেলে না?”
“কি হবে গিয়ে? মাইনে তো পাবো না। জানো পুরো তিন সপ্তাহের পয়সা বাকী। কিন্তু মালিকের ব্যবসা ঠিক চলছে। আসলে পয়সা দেওয়ার নিয়ৎ নেই লোকটার।”
“ তো কাজে না গেলে কি হবে?” আদুরে প্রশ্ন পূজার।
“আজ আমি গেলাম না। কাল আর একজন কেউ যাবে না। পরশু আর একজন – আর তারপর সবাই একসাথে। কাজ বন্ধ হয়ে যাবে মালিকের। বাধ্য হয়ে মাইনে দেবে। আমি বোঝাবো সবাইকে।”
মন দিয়ে শোনার পর হাসিচ্ছলে পূজার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ‘বিদ্রোহ’ শব্দটুকু দামুর জ্বলন্ত মনের আগুনে যেন ঘি হয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে সোচ্চার হল সে, “হ্যাঁ, করবো আমি বিদ্রোহ। নিজের জন্যে না হলেও অন্যের জন্যে। উচ্চ–নীচ, ধনী-গরীবের ভেদাভেদকে উপড়ে ফেলতে চাই মূল থেকে। আমি যদি পারতাম – ”
কথা কেটে মেয়েলিপনায় হাত জুড়ে বলে উঠল পূজা, ‘ ব্যস-ব্যস বাবা। আমারই ভুল হয়েছে। শান্ত হয়ে যাও।”
অনুরোধ স্বীকার করে শান্ত হয়ে বসতে বসতে বলে চলল দামু, “নিজের মনের মধ্যে ঘোঁটন হয় আমার। কেউ বুঝতে চায় না আমায়। বাড়িতে খাট ধরা অপাহিজ অসুস্থ বাপ যার ওষুধের খরচা সামলানো হয়েছে ভার। বিধবা দিদি কাজে যায় – তাও ইট ভাঁটাতে। মা নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাসন-কাপড় ধোয়। তবুও ছেলে যেন শহর না যায়। কেন না শহর গিয়ে নাকি কেউ ফিরে আসে না। ওখানেই নাকি চিরবাসিন্দা হয়ে থেকে যায়।”
প্রতিটা শব্দই পূজা হৃদয়ের গভীরে অনুভব করে দামুর প্রতি সহানুভূতি একত্রিত করছিল বটে কিন্তু শেষ দুটি বাক্য যেন তার মনের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠা ব্যক্তিগত পুরনো এক ব্যথাতে সপাট ঘা দিল। ছলছলে চোখে স্বগতোক্তি হল তার, “ ভুল তো কিছু নয়। আমার ভাইকে দ্যাখো। মা মারা যাওয়ার পর একবার এসেছিল। আর এখন হয়তো বাপ মরাতে – ” কণ্ঠ রুদ্ধ হল পূজার।
তার হাত দামু নিজের হাতে নিয়ে সহানুভূতি প্রদর্শন এবং নিজপক্ষ সমর্থন করল। “অমনটা বলো না। সবাই সমান হয় না। আমি শহর যেতেও চাই আর ফিরেও আসতে চাই।”
পূজা নিজেকে সামলে নিয়ে বাম হাতের একমাত্র সোনার চুড়িটা খুলে নিয়ে দামুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ এই নাও। এটা বেচে ‘বাপু’র জন্যে ওষুধ কেন। কিছু বাড়িতে দাও আর বাকীটা নিয়ে শহর যাও। আমার কাছে থাকলে এক না এক দিন এটা আমার মাতাল বাপের পেটে মদ হয়ে চলে যাবে। কিন্তু, তুমি ফিরে নিশ্চয়ই এসো।” ঠোঁট দুটো মৃদু হাসতে চাইলেও চোখদুটো কিন্তু বাধা মানল না।
গাল বেয়ে আসা চোখের জলের এক ফোঁটা হাতে ধরে দামু নিজের মন বদলে মুচকি হেসে চুড়িটা পূজার হাতে আবার পরিয়ে দিয়ে বলল, “ব্যস? এইটুকু হিম্মৎ? আমার শহর যাওয়াতো এবার একেবারেই ক্যান্সেল।” তওবা করার ভঙ্গীতে ডান হাত দিয়ে বাম কান আর বাম হাত দিয়ে ডান কান ধরে চোখের ইশারা করতেই পূজা হেসে ফেলে বলল, “ ধেৎ, আমি মানা তো কক্ষনও করিনি। আমি তো – ”
“তোমরা মেয়েরাও না, পারো বেশ। ” বলেই অট্টহাসি হেসে উঠল দামু।
দামুকে এরকম হাসতে দেখে পূজার মনে খুশী হওয়ার বদলে কেমন যেন এক দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরল। এতক্ষণ দামুর বিষণ্ণতা দূর করার জন্যই সে নিজের কথা বলেনি। কিন্তু বললে তার যা’ই প্রতিক্রিয়া হোক না কেন পূজা তার কাছ থেকে এত বড় একটা কথা লুকোতে পারে না।
পূজার চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে দামু হাসি থামিয়ে দিলেও তার শূন্যদৃষ্টি কাটল না। চোখের সামনে চুটকি বাজিয়ে নাম ধরে ডাকাতে তার সম্বিৎ ফিরে এলে দামুর প্রশ্নের জবাবে গম্ভীর হয়ে মুখ খোলে সে। “শয়তানটা আজ বাড়ি এসে বাবাকে ভড়কে দিয়েছে। কাল জানি না কি করবে।”
দামুর কুঞ্চিত ভ্রু দেখে পূজা বিল্টনের কথা খুলে বলতেই দামু আবার গর্জে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। “হারামজাদা কে এবার আমি – ”