(ধারাবাহিক উপন্যাস)
গত পর্বে –
চতুর সিং এর আড্ডায় অনৈতিক জুয়ার পর বাইজী নাচ শুরু হয়।
এদিকে সন্ধ্যা রত্নাকরের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে মাত্র আড়াই শো টাকা নিয়ে বাবাকে বাঁচানোর জন্যে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
গোধূলির পর ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে দামু দিদিকে দেখে সব বুঝতে পারে।
ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে সে রত্নাকরকে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
এদিকে চতুর সিং এর আড্ডায় বিল্টন কুড়ি টাকার নোট নর্তকীর ওপর ওড়াতে থাকে।
এর পর
ষষ্ঠ/শেষ পর্ব
প্রতিশোধ
মুনিম চোখ চালিয়ে পুরনো ভিডিও হলের আমল থেকে অনেক ওপরে ঝোলানো লাল নীল কাগজ জড়ানো ইলেকট্রিক বাল্ব গুলোর রঙ্গিন আলোতে বিল্টনকে খুঁজে নিয়ে দ্রুত তার কাছে পৌঁছেই চাপা গলায় নাকি কান্না শুরু করে দিল। “ছোট মালিক, সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
খুব একটা কান না দিয়েই বিল্টন টলতে টলতে নিজের টেবিলের দিকে যেতে যেতে মুনিমের দ্বিরুক্তির জবাবে নেশা জড়ানো গলায় বলে উঠল, “কি হয়েছে মুনিম? তোমার বাড়িতে কেউ মারা যায়নি তো?”
একটু অসন্তোষের সাথে মাথা নেড়ে বিল্টনের সাথে পা মিলিয়ে চলতে চলতে মুনিম বলল, “ছোট মালিক, ভগবান আপনাকে সহ্য করার শক্তি দিক। আপনার ওপর ভগবানের কুদৃষ্টি পড়েছে। হে ঈশ্বর, কৃপা কর।”
এতক্ষণে নিজের জায়গায় এসে বসতে বসতে জড়ানো গলায় বিল্টন টিপ্পনী করল, “আরে, কি হেঁয়ালি করছ তুমি মুনিম? কোন শালা কি করেছে আমার? বল।”
“আজ্ঞে, দামু – ছোট মালিক,”
ঢুলু ঢুলু চোখে বিল্টন মুখের মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করে উঠতেই মুনিম এক নিশ্বাসে বাক্যটা পুরো করল, “বড় মালিককে মেরে দিয়েছে। খুন করেছে তাকে।” এবারে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল মুনিম।
অনেক আগে ছেড়ে যাওয়া আধ খালি মদের গ্লাসটা তুলতে গিয়ে বিল্টনের হাত ঘষড়ে গ্লাসটা গড়িয়ে গেল টেবিলের অন্য কোণা পর্যন্ত। নেশায় আরক্ত তার চোখদুটোর বিস্ময় আর অবিশ্বাসের মিশ্র দৃষ্টি স্থির হয়ে পড়ল মুনিমের মুখের ওপর। তার ঠোঁট ঝোলানো খোলা মুখের দিকে তাকিয়ে মুনিম বলে চলল পুরো ঘটনাটি। হতভম্ব বদ্রী আর বিল্টনের দুই চ্যালা একবার বিল্টনকে আর একবার মুনিমকে দেখতে থাকল।
মুনিমের কথা শেষ হলে সবাই যেন রত্নাকরের কল্পিত মৃতদেহের এক ঝলক দেখতে পেল। সবাই নির্বাক। স্টেজ থেকে ঘোষণা হচ্ছিল কোন বিশেষ কারণে আজ আর নাচ হবে না এবং ‘বার’ বন্ধ হয়ে যাবে। এরকমটা মাসে এক আধ বার হত। পুলিসের নকল তদন্তের খবর তাদেরই লোক আগে ভাগে দিয়ে যেত। আর পরে তারাই এসে ভরপুর খেয়ে মেখে মস্তির সাথে সাথে পকেটও গরম করে ভবিষ্যৎ বেআইনি কাজের জন্য আশীর্বাদ এবং সমর্থন দুটোই দিয়ে যেত। বলা বাহুল্য ‘বার’এর দুজন ‘বাউন্সার’ ভদ্র ভাবে গ্রাহকদের প্রায় তাড়িয়ে দিচ্ছিল বিল আদায় করে। এরকমটা বোম্বাই-দিল্লীর বেআইনি ‘বার’ গুলোতে প্রায়ই দেখা যায়।
প্রথম মৌন ভঙ্গ করল জগ্গা। “ভাইজী, পুলিসকে খবর –”
দাঁত চিবিয়ে দুঃখ রহিত রক্তচক্ষু দুটোতে প্রতিশোধের ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে কথা কাটল বিল্টন, “না, পুলিস নয়। আমি নিজে ওই শুয়োরের বাচ্চাকে সাজা দেবো। আজ তার জীবনের শেষ রাত হবে। লাল ভাই, রাসীদ আর সংকটকে খবর দে। ওদেরকে বল ওই শালা হারামজাদার বস্তির চার দিকে থাকতে। হারামি পালাতে যেন না পারে। আমরা প্রথম ইট ভাঁটাতে যাবো। মোটরসাইকেলটা স্কুল মোড়ে – রেখে যাবো। চলো – মুনিম।” নেশার ঘোরে শেষের কথাগুলো তার জড়িয়ে গেল। বেরোতে গিয়ে টেবিলের কোণা লেগে টাল সামলাতে না পেরে পড়ল সে বদ্রীর ওপর। মুনিম তাকে সামলাতেই বদ্রীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা থেকে নিজেকে রহিত করে জুয়াতে জেতা বাকী টাকা থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট জগ্গাকে দিয়ে “বিল চুকিয়ে তোরা পেছনে আয়” বলে টলতে টলতে মুনিমের সাথে বেরিয়ে গেল। বদ্রীর মাথায় প্রথম প্রথম ঢুকছিল না যদিও কিন্তু এখন সে সব বুঝে দামুর সর্বনাশ কামনা করে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
***
রাতের নমাজ না পড়েই দরজায় সেকল দিয়ে হারিকেনটার বাতি কমিয়ে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল জুবেদ। অশুভের সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল সে হরিরামের বাড়ির ভেতর।
মেয়ের বদনাম স্বামীর মৃত্যুর চেয়ে যেন ভারী মনে হয়েছিল রাইমনির কাছে। আড়ষ্ট হয়ে স্বামীর মাথার দিকে খাটের কোণায় মাথা রেখে ছেলের ফেরার অপেক্ষায় বসেছিল সে। পায়ের দিকটাতে সন্ধ্যা তদ্রূপ অনুভূতির সাথে মাথা হেঁট করে বসেছিল। মাটিতে রাখা হারিকেনটার চিমনির উপরিভাগ পুরো কালো হয়ে যাওয়াতে খাটের ওপর হরিরামের বেদনা ভরা মৃত মুখের ওপর বেরিয়ে আসা চোখদুটো ছাড়া আর কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না বটে তবে মেঝেতে বসা সন্ধ্যা আর রাইমনির চোখের জল সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
জুবেদ ঘরে ঢুকে টর্চের আলোতে হরিরামের প্রাণহীন দেহটা দেখেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল রাত্রির সর্বনাশা এই প্রহরটা এই ঘরেই হানা দিয়েছে।
“ইয়া আল্লাহ্! রহম কর। বহিন ধৈর্য ধর। আল্লাহ্ তোমায় শক্তি দিক। দামু কোথায়?”
চাপা গলায় কথা শুরু করতেই রাইমনি আর সন্ধ্যা চমকে উঠে জুবেদকে দেখে কেঁদে উঠেছিল। দামুর কথা উঠতেই সন্ধ্যার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। এতক্ষণ তার দামুর কথা মনের মধ্যে ছিল না। জুবেদের পেছনের দরজা দিয়ে আসা এবং চাপা গলায় কথা বলা দেখে রাইমনির দুঃখে বিভোর মনে সন্দেহ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছিল। প্রশ্নবাচক দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকাতেই জুবেদ বলে উঠেছিল, “ভাঁটাতে মালিকের খুন হয়ে গেছে। দামু সেখানে গেছিল। মুনিম বিল্টনকে খবর দিতে গেছে। দামু কোথায়?”
রাইমনি আর সন্ধ্যা একে অপরের মুখ চাওয়া চাই করে নির্বাক থেকে গিয়েছিল। এমন সময় বটগাছের নীচে দীর্ঘ সময় চোখের জল ফেলার পর ধীরে ধীরে মনকে শক্ত করে সাহস সঞ্চয় করে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া দামুও পেছনের দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। জুবেদের কথা তার কর্ণগোচর হয়েছিল।
পায়ের শব্দ শুনে রাইমনি সমেত সবাই তাকাল দামুর দিকে। রাইমনি উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেকে টেনে নিয়ে স্বামীর বিয়োগ ভুলে বলে উঠল, “এ তুই কি করলিরে, বাবা?”
“মেরে দিয়েছি আমি ওকে। শাস্তি দিয়েছি ওকে ওর পাপের।” একেবারে স্থির ভাবে মা’র দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে গিয়ে জুবেদকে হরিরামের পায়ের দিক থেকে চাদরটা টেনে তার মুখ ঢেকে দিতে দেখে ‘বাপু’ বলে ছুটে গিয়ে হরিরামের বুকের ওপর মাথা রেখে বিলাপ করতে লাগল দামু। রাইমনি তার কাঁধে হাত রেখে তাকে হতচকিত করে নিজের মুখের ওপর আঙ্গুল রেখে চুপ থাকার ইশারা করে বলে উঠল, “ শ্ -শ্ -শ্ ! তোর বাপু তো চলে গেল। তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখতে চেয়েছিল। ও তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তুই ফিরে আসতে পারবি। যা, পালিয়ে যা। পালিয়ে যা এখান থেকে। তুই শহর যেতে চেয়েছিলি না? যা – অনেক দূরের কোন শহরে পালিয়ে যা যেখানে কেউ তোকে খুঁজে পাবে না।”
সন্ধ্যা চোখের জলের সাথে বুকফাটা কান্না চাপা দিতে চাইলে রাইমনি তার উদ্দেশ্যে ফুফিয়ে কেঁদে বলে উঠল, “ বুঝিয়ে বল না রে তোর ভাইকে। ‘মরদ’ তো হারিয়ে ফেলেছি – ছেলেকে যে হারাতে চাই না।”
বড় কিছু একটা হারানোর করুণ অনুভূতিতে হঠাৎ জুবেদের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সন্ধ্যার সাথে দামুকে বোঝাতে সে বলে উঠল, “হ্যাঁ বেটা, পালিয়ে যা। তুই বাঁচলে তোর মা বাঁচবে।”
আবার ফিরে আসা চোখের জলে গাল ভিজিয়ে দামু রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, “তাহলে কি একমাত্র ছেলে বাপের মৃত শরীরকে ফেলে পালিয়ে যাক? লাচার বুড়ো মায়ের ওপর সেই বোঝা – তার স্বামীর মৃতদেহের বোঝা চাপিয়ে – পালিয়ে যাই আমি?”
কটুভাষী রাইমনি এবার ভেঙ্গে পড়ল। “চুপ কর বাবা। অমনটা বলিস না। তুই ই তো আমার সব।” মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগে উঠে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে নিজেকে সংযত করে দামু বলল, “পালাতেই যদি হয় তাহলে সবাই যাবো। বাপুর চিতা জ্বালানোর পর।” কথাগুলো একটানে বলে জুবেদের দিকে তাকাতেই সে বলল, “তাহলে দেরি করিস না। শীগগির চল। কাঠ কাটতে হবে।” জেদি ছেলের প্রস্তাবে নীরব সায় দিয়ে সব ভুলে ব্যস্ততার সাথে রাইমনি চট করে ভেতর থেকে কুড়ুল এনে দামুর হাতে দিল। দামু সজল চোখে সামনের দরজার দিকে এগোতে গিয়ে থেমে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। জুবেদ পেছনে থেকেই টর্চের আলো দেখাতে থাকল।
***
তালা খুলে মুনিম অফিস ঘরে ঢুকে বিল্টনকে সামলে আসতে বললে টলতে টলতে এখনও নেশায় চূর বিল্টন ঠাওরে ভেতরে ঢুকে বলে উঠল, “আলো তো জ্বালাও মুনিম। মরা বাপের মুখ দেখে বেরবো যে।”
টর্চের আলো না ফেলে বাঁ পকেটে রাখা দেশলাইটা বার করে খাটের নীচে কোণায় রাখা কেরোসিন ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে খাটের ওপরে রাখতেই শিউরে উঠল বিল্টন। ভাঙ্গা টিভিটার পাশে পড়েছিল রত্নাকরের দেহটা। জিভ ঝুলে পড়া ভয়ার্ত খোলা মুখের রক্ত প্রায় শুকিয়ে গেছিল। চোখদুটো ফেটে বেরিয়ে এসেছিল যেন। অগোছালো ধুতির ওপর ছিঁড়ে যাওয়া পাঞ্জাবিটা কোমর থেকে উপরে উঠে এসেছিল।
ল্যাম্পের ক্ষীণ আলোতেও বিল্টনের রক্ত চক্ষুর কোণাতে পিতৃবিয়োগের দুঃখের চিহ্নস্বরূপ অশ্রুবিন্দু দেখতে পেল মুনিম।
“খুব মেরেছে রে বাপুকে – শালা হারামি। তুমি চিন্তা করো না বাপু। গুনে গুনে শোধ নেবো।” হাস্যাস্পদ শোনালেও কথাগুলো বলতে বলতে চোখের জল মুছে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে খাটের ওপর মাথা ঝুলিয়ে বসে পড়ল বিল্টন। আর মুনিম বেরিয়ে গিয়ে দেবুর ঘরে তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে শোক পালনের নীরব সাক্ষ্য হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল খাটটার এক কোণায়। বেশ কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল রত্নাকরের পাঞ্জাবির পকেটে রাখা মোবাইল ফোনের একঘেয়ে বিরক্তকর রিংটোনের চাপা শব্দে। বিল্টন মাথা তুলতেই মুনিম এগিয়ে গিয়ে থমকে গেল। নেশার ঘোর এখনও পুরো মাথায় বিল্টন বলল, “দেখ মুনিম।”
মৃতদেহটা মুনিম ছুঁতে চাইছিল না বটে কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে দেহটাকে একটু নাড়িয়ে পেটের ওপরদিকে কুক্ষিস্থল গত বাঁদিকের পকেট থেকে সমানে বেজে যাওয়া ফোনটা তাড়াতাড়ি বের করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে বলল, “বাড়ি থেকে ছোট মালিক।”
“দাও”
চট করে বোতাম টিপে বিল্টনের হাতে ফোনটা দিল মুনিম।
বাড়িতে রয়ে যাওয়া একমাত্র সদস্যা বর্তমানে ঘটে যাওয়া সবকিছুর অজান্তা মায়ের আওয়াজ শুনে বিল্টন বলে উঠল, ‘মা, আমি বাপুর সাথে রয়েছি। বাপু দূরে যাবে – তাই আজ আসবে না – আর – আমার – একটু দেরী হবে।”
থেমে থেমে কথাগুলো বুঝিয়ে বলল বটে কিন্তু বৃদ্ধা বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট না হয়ে সম্পূর্ণ দেহাতী ভাষায় ঝাঁঝিয়ে উঠল, “হ্যাঁ- হ্যাঁ, ঠিক আছে। আজ তাড়াতাড়ি আসবে বলেছিল তাই ফোন করেছিলাম। আর তুই আবার মদ গিলেছিস? সকালেই তো বললি আর খাবি না। কেন খাস এসব ছাই পাঁশ? …”
বিল্টনের শোনার ধৈর্য শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং এই উপযুক্ত মুহূর্তে দুই চেলার প্রবেশ হতেই ফোনটা কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে নিজের পকেটে রাখতে রাখতে সে গুমরে বলে উঠল, “এসেছিস তোরা। শোন – ওই হারামির বংশকে শেষ করতে হবে। পুরো বস্তিটাই শেষ করে দে। শুধু ওই শুয়োরের বাচ্চাকে ছেড়ে দিস। ওকে আমি মারবো। চল।”
লাল শিংএর থেকে সদ্য পাওয়া দেশী বেআইনিভাবে বানানো রিভলবারটি দেখিয়ে বেরোতে বেরোতে জগ্গা শোনাল, “আমাদের বাকী লোক ওদের বস্তির কাছে গেছে।”
একটা ‘হুঁ’ দিয়ে বিল্টন ছোটে লালের হাত থেকে তার রিভলবারটা নিয়ে চলতে লাগল। মুনিম একটু ভেবে ল্যাম্পটা নিবিয়ে দরজা খোলা রেখেই টর্চ জ্বালিয়ে অন্ধকারের মধ্যে রত্নাকরের পুরনো জীপগাড়িটাকে যথাস্থানে পড়ে থাকতে দেখে বাকীদের পেছন নিল। বেরোনোর আগে শেষ বারের মত রত্নাকরকে দেখে তার প্রায় অধিকাংশ পাপের ভাগীদার এই মুনিমের একবারও খেয়াল হল না যে এই ভয়ংকর মৃত্যু মনুষ্য প্রদত্ত হলেও সেটা তার অগণিত পাপের পরিণাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
***
নেশার তুঙ্গে টলতে টলতে বাইরের গেট দিয়ে ঢুকে বদ্রী ঘরের ভেতরে আলো জলতে দেখেছিল। কপাল কুঁচকে দরজা চাপড়াতেই ভেতর থেকে ভারাক্রান্ত মনে পূজা ছিটকিনি খুলে দিয়েছিল। দরজা খুলছে না দেখে আবার চাপড়াতে পূজা ভেতর থেকে বলেছিল, “বাইরের থেকে ছিটকিনি লাগানো, বাবা।”
বদ্রী কথাটা শুনে বোধগম্য করতে একটু সময় নিয়েছিল বটে কিন্তু পরে তার দুপুরের সব কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আর তখনই আরও একটু অস্বস্তির সাথে দুপুরে নিজেরই বন্ধ করা বাইরের ছিটকিনিটা খুলে চৌকাঠ ধরে ভেতরে ঢুকে পড়ে জিজ্ঞেস করেছিল সে, “তুই ঘুমোসনি এখনও?”
“মা-হারা সোমত্ত মেয়ের বাপ মাতাল হলে তার চোখে ঘুম কমই আসে।”
পূজার এই শ্লেষ বদ্রী এড়িয়ে গিয়ে বর্তমানকে আধার করে নিজের পছন্দ মত কাল্পনিক ভবিষ্যৎ ফলের স্বাদ নিতে নিতে বলে ফেলেছিল, “এবার আসবে ঘুম। চাকরানীর ব্যাটা মরলে পরে আমারও চিন্তা হবে শেষ।”
বদ্রীর হেঁয়ালি কথায় পূজার মনে সন্দেহ হওয়াতে প্রশ্ন করেছিল সে, “কি বলছ তুমি এসব বাবা?” জবাবে মাতাল বদ্রী রত্নাকরের হত্যা এবং বিল্টনের পরিকল্পনার ব্যাপারে গোপনীয়তা রাখার নিমিত্ত চাপা গলায় সবকিছু সংক্ষিপ্ত শুনিয়ে দিয়ে পূজাকে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে বলে ভেতরের ঘরে নিজে শুতে চলে গিয়েছিল।
বেশ কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকার পরে এখন এক অজানা ভয় এবং ব্যাথার মিশ্র অনুভূতি পূজাকে সচেতন করল। দুপুরের প্রানাহুতি দেওয়ার কথা মনে পড়ে যেতে তার ভয়ের অনুভূতিটা কেবলমাত্র ব্যথার বাষ্প হয়ে দুচোখে ছল ছল করে উঠল। শোকাকুল আড়ষ্ট হৃদয়ে দুগাল বেয়ে যাওয়া চোখের জলের সাথে আরও কয়েক মুহূর্ত নীরব দাঁড়িয়ে থাকার পর হাট করে খোলা দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
***
ছমছমে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে মাঝে মাঝে পেছন থেকে ফেলা মুনিমের টর্চের আলোতে চলার ফাঁকে থেমে থেমে “সবাইকে শেষ করে দেবো” এই একই কথা বলতে বলতে বিল্টন পুরনো শ্মশান ঘাটের রাস্তাটা ধরল। বছর আটেক আগে পর্যন্ত এটা পাঁচ গাঁয়ের যৌথ শ্মশান ছিল। এখন স্থান বদল হয়ে তিন গাঁয়ের বাইরে তিনটে শ্মশান হয়ে যাওয়াতে এই জায়গাটাতে বড় বট-অশ্বত্থ-নীম যা ছিল তার সাথে বনবিভাগের অধীনে পঞ্চায়েত থেকে রোপণ করা ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি আরও কিছু গাছপালা বড় হয়ে যাওয়াতে এটা এক ছোট ঘন জংগলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আর জংগল পেরিয়ে কিছুটা এগোলেই দলিত বস্তি।
***
বদ্রী চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে আকাশ পাতাল ভেবে শুতে যাবে এমন সময় তার নজর কাড়ল বাইরের ঘর থেকে আসা হারিকেনের আলোটা। কি একটা ভেবে মেয়ের খবর নিতে বাইরের ঘরে এসে দেখল পূজা নেই। দরজাটা তেমনিই হাট করে খোলা যেমনটা ও ঢোকার সময় করে এসেছিল।
“প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে। এর ভোগান্তি আছে।” কথাগুলো আনমনা হয়ে বলে অপত্যস্নেহের বশে কিংবা মেয়ের আসন্ন বিপত্তির সংকেত পেয়ে তাকে বাঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে মেয়ের সম্ভাব্য গন্তব্যস্থলের দিকে চলতে লাগল বদ্রী।
***
পেছন থেকে টর্চ দেখাতে দেখাতে মুনিম হঠাৎ চাপা গলায় বলে উঠল, “ছোট মালিক, কেউ একজন ওখানে যাচ্ছে বোধহয়!”
“ঘিরে নে ওকে। আমাদের কেউ নয় তো?” থেমে গিয়ে বিল্টন বলল সন্দিগ্ধ ভাবে।
টর্চ বন্ধ রেখে আন্দাজে এগিয়ে গিয়ে ছায়ামূর্তিটাকে ঘিরে ফেলল চার জন। এবারে তার ওপর টর্চের আলো ফেলতেই মুখে হাত আড়াল করা পূজার অবয়ব স্পষ্ট হল।
পূজার বাড়ির সামনের রাস্তাটায় ডান দিকে একটু এগিয়ে বাঁদিকের একদম সরু একজন মানুষ চলার মতো রাস্তাটা সোজা জংগল পেরিয়ে বস্তিতে গিয়ে শেষ হয়েছিল। অতীতে বহুবার অন্ধকারে চলা ঐ রাস্তাটাই আজ ধরেছিল পূজা। ভাঁটার দিক থেকে এসে বিল্টনরা ধরেছিল অন্য একটা পায়ে চলা রাস্তা যেটা প্রায় বস্তির কাছাকাছি জংগলের শেষ ভাগে এসে পূজার নেওয়া সরু রাস্তাটায় মিশেছিল।
ভয়ে, চিন্তায় এবং দুঃখে বিহ্বল পূজার নজরে টর্চের আলোটার এক ঝলক এসেছিল বটে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তার সেদিকে খেয়াল গিয়েছিল না।
এখন চোখ ধাঁধানো আলোর পেছনের কণ্ঠস্বর শুনে শয়তানের আবির্ভাব হয়েছে বুঝে তার হাত পা যেন অবশ হয়ে এল। সব ভুলে বিল্টনের মুখ থেকে বেরুল স্বভাবজাত শ্লেষ, “বাঃ! মাঝ রাতে হবু স্বামীর সাথে দেখা করতে এসেছিস! তোর বাপ মানে আমার ‘স্বশুরজী’ পাঠাল নাকি তোকে?”
পূজা নির্বাক দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তার ক্রোধাগ্নিকে স্ফুরিত করে যেন শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করছিল।
“কিরে – মুখ সেলাই হয়ে গেছে নাকি? সকালে তো খুব তুবড়ি ছুটছিল।” কথাগুলো অসংলগ্ন এবং শ্লেষযুক্ত ছিল বটে কিন্তু বিল্টনের কণ্ঠস্বরে ক্রোধ এবং প্রতিশোধের ভাবনা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
“কি বলেছিলি? ‘হারামিগিরি’ – হ্যাঁ, এখন দেখাবো তোকে হারামিগিরি – বিয়ের আগে ফুলশয্যা করে।” বলতে বলতে বিল্টন এক পা করে এগোচ্ছিল আর পূজা এক পা করে পিছোচ্ছিল। হঠাৎ পূজার পায়ের নীচে কিছু লাগতেই ও বুঝল ওটা একটা গাছের ডাল। আত্মরক্ষার একমাত্র অস্ত্র মনে করে মুহূর্তের মধ্যে ডালটা উঠিয়ে দুহাতে এদিক ওদিক এলোপাথাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলতে লাগল সে, “বিয়ের স্বপ্ন ভুলে যা হারামি। সরে যা সামনে থেকে।”
বিল্টন রিভলবারটা বার করে ধমকাতে যাচ্ছিল কিন্তু ডালটার আঘাতে সেটা তার হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর পূজার ডালটা দিয়ে আঘাত করার উপর্যুপরি দু’তিনটে প্রয়াসের শেষটা সফল হল বটে কিন্তু পরেরটাতে ক্ষিপ্রগতিতে বিল্টন ডালটা ধরে নিজের পেছন দিকে হ্যাঁচকা টান দিতেই পূজার হাত থেকে ওটা ছিটকে বেরিয়ে গেল আর ঝটকা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে সে এসে গেল বিল্টনের প্রায় নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্বের মধ্যে। দ্রুত পিছ পা হওয়ার আগেই বিল্টন খপ করে ধরে ফেলল কাঁধের নীচে তার হাতটা।
“কি ভেবেছিস? আমি জানি না – তুই সেই শুয়োরের বাচ্চাকে খবর দিতে যাচ্ছিস?”
নিজেকে ছাড়ানোর অসফল প্রয়াস করতে করতে পূজা ফোঁস করে উঠল, “হ্যাঁ, ওখানেই যাচ্ছি আমি। ছাড় আমায় – হারামি। উঃ!”
নেশার ঘোরে পুরো জোর লাগিয়ে সংঘর্ষে রত পূজাকে নিজের নীচে মাটিতে শোয়ানোর চেষ্টা করতে করতে দাঁত চিবিয়ে কামাতুর বিল্টন বলে উঠল, “এবার দেখাচ্ছি শালী তোকে – ‘হারামিগিরি’ – সবার সামনেই করবো।”
বিল্টনের নীচে পূজা এবার দুহাত দিয়ে তাকে আটকে এক লাথি কষে ফসকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় বিল্টন তার জিপ ওয়ালা কামিজটা ধরে টান দিতেই জিপটা কেটে গিয়ে পেছনের দিকটা ছিঁড়ে যেতে লজ্জা ঢাকতে গিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে আবার অসফল পূজার নগ্ন পিঠটা বিল্টনের হাতে লাগল। অন্ধকারে পরিলক্ষিত না হলেও ঘিরে দাঁড়ানো তিন জনের মুখে সন্তুষ্টি, জিজ্ঞাসা এবং কামবাসনার স্পষ্ট পরিস্ফুটন ছিল। নিরুপায় পূজা হাত এবং পায়ের গোড়ালির জোর লাগাতে লাগাতে গুমরে উঠল, “পাপী, জেনে রাখ – তোর বাপ মরেছে দামুর হাতে আর তুইও মরবি।”
“তুই চিন্তা করিস না। তোর সাথে ফুলশয্যা হয়ে যাক তারপর তাকে – মানে তোর নাগরকে যমালয়ে পাঠিয়ে দেবো।” চিবিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে বিল্টন পূজার কামিজটা পুরো ছিঁড়ে ফেলতেই হাত খোলা পেয়ে পূজা তার গালে একটা চড় কষে মুখে থুথু ফেলে কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, “ছেড়ে দে আমায় হারামজাদা।”
নিজের দুহাত দিয়ে পূজার দুহাত চেপে বিল্টন আক্রোশ মেটাতে বলে উঠল, “দেবো ছেড়ে তোকে। আরে, চেপে রাখ তো শালীর হাত দুটো।”
হুকুম তামিল করার জন্যে জগ্গা আর ছোটে লাল এগিয়ে এসে পূজার দুদিকে দাঁড়িয়ে তার কব্জি দুটোর ওপরে পা দিয়ে চেপে রাখল। পালিয়ে বাঁচার নিরাশায়, শারীরিক যন্ত্রণায় এবং দুঃখে পূজা ফুফিয়ে কেঁদে উঠল।
ক্রোধাগ্নি এবং কামাগ্নিতে তপ্ত বিল্টন অতি দ্রুত পূজার উরুর ওপর বসে তার পুরো ছেঁড়া কামিজটা টেনে একপাশে করল।
কালো রাতে, কালো জংগলে কালো কালো কামাতুর মনুষ্যরুপী ব্যভিচারী চার দানবের চোখে বাস্তব এবং কল্পনার মিশ্রনে উন্নত যৌবনা পূজার সম্পূর্ণ নগ্ন উপরিভাগ যেন আলোকোজ্জ্বল স্পষ্ট দৃষ্ট হচ্ছিল।
স্বল্পক্ষনের ব্যবধানে পূজার ভয়ার্ত এবং আকুতিপূর্ণ ক্রন্দনের সাথে বিল্টন যখন তার মধ্যে প্রবেশ করল উন্মুক্ত আকাশের স্পষ্ট তারা-গ্রহরা তখন গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে তা দেখে যেন মেঘের পর্দা করে নিজেদের মুখ লুকোল।
***
বদ্রীর নিশ্চিত ধারণা ছিল পূজা বস্তির রাস্তাটাই ধরবে। তাই টলটলে মাথা নিয়ে যতটা সম্ভব সতর্কতার সাথে এগোতে এগোতে এখন তার কানে পূজার কান্নার শব্দ পৌঁছুতেই থমকে দাঁড়িয়ে শ্রুত শব্দের দিক নির্বাচনে ব্যস্ত হয়ে উঠল সে। গলা থেকে তার আওয়াজ বেরোচ্ছিল না যদিও তবুও আবেগ জড়িত কণ্ঠে মেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল কান্নার শব্দের উৎসের দিকে।
কিছুটা এগিয়ে দেখার চেষ্টা করলে পর তার মনে হল অনতিদূরে কয়েকটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর একজন মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল আর তার পায়ের কাছে কেউ যেন পড়ে রয়েছে।
বস্তুত বিল্টন উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের বেল্ট লাগিয়ে কিছুক্ষণ আগে নিজের হাত থেকে পড়ে যাওয়া রিভলবারটা তুলে নিয়েছিল।
অসহ্য ব্যথায় ককিয়ে উঠে রুদ্ধ গলায় পূজা অভিশাপ দিল, “মরবিরে তুই – ভগবান তোকে মারবে।”
তার কথাতে কোন ভ্রূক্ষেপ না করেই বিল্টন বলে উঠল, “আরে, তোরাও চেখে নে – এর যৌবনের স্বাদ। এমন অবস্থা করে দে যাতে সকালে কাউকে মুখ দেখাতে না পারে।”
এতক্ষণে বদ্রীর কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মেয়ের নাম ধরে ডেকে তাকে ছাড়ানোর জন্যে এগোলে বিল্টন তাকে বাধা দিল। জগ্গার নীচে থেকে পূজার বুকফাটা কান্না বেরোল, “আমায় বাঁচাও, বাবা।”
মাতাল বদ্রী এবার পিতা বদ্রীপ্রসাদ হয়ে শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করে বলে উঠল, “এ বিল্টন, ছেড়ে দে আমার মেয়েকে।”
“দেবো – ছেড়ে নিশ্চয়ই দেবো। সবার হয়ে গেলে। আর তারপর তাকে দিয়ে ‘ধান্দা’ করাবি। আমরা হবো তোর পাকা গ্রাহক।” সকালে নিজের রচিত চরম নাটকের যবনিকা পাত করে নির্দ্বিধায় বলে উঠল বিল্টন।
ধস্তাধস্তি করে বিল্টনের গলা টিপে ধরে ব্রাহ্মণ জনোচিত ক্রোধ প্রদর্শন করে বলে উঠল, “আমি মেরে দেবো তোকে। মানুষরূপী তুই একটা জানোয়ার।”
বেগতিক দেখে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিল বিল্টন বদ্রীকে। ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল বদ্রী। তার মাথাটা সোজা ঠুকল কবেকার পড়ে থাকা ছুঁচোল ভাঙ্গা ইট কিংবা পাথর কিছু একটার ওপর। তীব্র যন্ত্রনার এক ছোট্ট আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। আর তক্ষুনি অতি ক্ষীণ স্বরে পূজার মুখ থেকে বেরুল কেবল মাত্র ‘বাবা’ শব্দটা।
বদ্রীর মাথার নীচটা সরসর করে রক্তে ভিজে যাচ্ছিল। শেষ বারের মত সে পূজার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েও পারল না। আধখোলা চোখের জলে ভাসা দুঃখ, ঘৃণা এবং অনুশোচনায় ভরা মুখটার সাথে সবকিছু স্পন্দনহীন হয়ে যাওয়ার আগে তার যেন মনে হল আর একটা ভয়ংকর দানব তার একমাত্র আদুরে সুন্দরী কন্যার বক্ষস্থল থেকে তার রক্তাক্ত হৃদয়টা ছিঁড়ে বার করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
***
দামু বেশ কিছু কাঠ জোগাড় করে ফেলেছিল। কিছু শুকনো বড় আর কিছু কাঁচা ছোট ডাল। জুবেদ কাঠগুলো এনে এক জায়গায় রাখছিল। উদাস মনে ঘর্মাক্ত মুখে দামু জুবেদের দিকে চেয়ে বলল, “চাচা, শ্মশান তো পৌঁছুতে পারবো না। এই খানেই কোথাও চিতা সাজাতে হবে।”
“হ্যাঁ, তাহলে পুরনো শ্মশানের পাশে খালি জায়গাটাতেই ঠিক হবে। আমি কিছু কাঠ নিয়ে ওখানে রেখে আসি আর তুই ঐ দিকটা থেকে কিছু শুকনো কাঠ দ্যাখ।” চাপা গলায় কথাগুলো বলে জুবেদ খানকয়েক কাঠ কাঁধে এবং হাতে করে চলতে আরম্ভ করল। আর শুকনো কাঠের সন্ধানে দামু জংগলের ভেতর দিকে এগিয়ে গেল কুড়ুলটা নিয়ে।
***
বিল্টনরা বস্তী আর জংগলের শেষ সীমানার মাঝখানের খালি জায়গাটাতে পৌঁছে গেছিল। বস্তী এবং জংগল দুটোই এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
“কোথায় রে ওরা সব?” বিল্টন কাউকে না দেখে নিরাশা ভরা প্রশ্ন ছুঁড়ল।
জগ্গা ক্ষীণ হয়ে আসা টর্চের আলো ফেলে ইশারা করতে করতে চিন্তিত হয়ে জবাব দিল, “লাল ভাই আর সংকটকে তো এখানেই আসতে বলেছিলাম। রাসীদরা বস্তী ঘিরে রাখবে বলেছিল।”
বলা বাহুল্য পূজার গণ ধর্ষণের সময় জগ্গা মুনিমের কাছ থেকে টর্চটা নিয়ে রেখেছিল।
মোবাইল ফোনের বহুল প্রচলন না হওয়ার কারণে আকাঙ্ক্ষিতদের মধ্যে শুধু লাল শিংএর কাছেই মোবাইল ফোন ছিল এবং সেটাও ইতিপূর্বেই বন্ধ বলে ঘোষিত হয়েছিল।
“ ‘শশুরা’ সব হারামখোর শালা।” বিল্টনের এই উক্তির পরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কারোর কিছু করার ছিল না।
***
দামু আনমনা হয়ে বেশ কিছুটা ভেতরে চলে এসেছিল। হঠাৎ যেন তার মনে হল দু’পা পেছনে কেউ বোধহয় পড়ে রয়েছে। গিয়ে দেখতেই দামুর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। দিশেহারা দামুর দুচোখ আবার জলে ভরে এল।
হাঁটুর নীচে নামানো শালোয়ারটা ছাড়া সম্পূর্ণ নগ্না পূজা পা দুটো মুড়ে কাত হয়ে পড়েছিল আর বাঁদিকের কাঁধের ওপর মাথা তার হেলে পড়েছিল। বাম হাতটা সটান মাটিতে ছড়ানো। ডান হাতের মাটি কামড়ে রাখা আধখোলা মুঠোটা তার উত্থিত হওয়ার অসফল প্রয়াস ব্যক্ত করছিল।
রুদ্ধ গলায় পূজার নাম ধরে ডাকল দামু। নিজের নামটা ভগ্ন হয়ে পূজার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছুলেও তার অল্প খোলা এখনও জল ভেজা চোখদুটোর শূন্য দৃষ্টিটা দামুর প্রতিচ্ছবি বানাতে পারল না। নাড়া দিয়ে ঝাঁকিয়ে ডেকে তুলতে পূজা আর এক দানবের আকার কল্পনা করে ককিয়ে উঠল, “ছেড়ে দে – ছেড়ে দে রে – আমায় ছেড়ে দে।”
শোক বিহ্বল দামু কেঁদে উঠে বলল, “আমি গো পূজা – দ্যাখ, আমি দামু।”
পুনঃ প্রচেষ্টায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দামুর দিকে চেয়ে তার হাত নিজের হাতে নিয়ে জলভরা চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি চালিয়ে ‘বাবা’ বলে হাত দিয়ে ইশারা করে কেঁদে উঠল পূজা।
হাতের ইশারা অনুসরণ করে বদ্রীর অবয়বটা দেখতে পেল দামু। পাশে পড়ে থাকা ছেঁড়া কামিজটা পূজার ওপর ঢেকে সে বদ্রীর দিকে একটু এগোতেই পূজা ঘষড়ে ওঠার চেষ্টা করে অসফল হয়ে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। পিছিয়ে এসে সে তখন পূজাকে কোলে তুলে কুড়ুলটা হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে বদ্রীর কাছে গিয়ে পৌঁছুল। পূজাকে তার প্রাণহীন দেহটার পাশে বসিয়ে দিয়ে কাঁধ ছুঁয়ে ‘কাকা’ বলে ডেকে একটু নাড়া দিতেই তার মাথাটা সূচালো পাথরটা থেকে গড়িয়ে গেল মাটিতে। পিতৃবিয়োগে বিদীর্ণ হৃদয়ে পূজা ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। “মেরে দিয়েছে বাবাকে ঐ শয়তানটা।”
“কে? ওই না?” দামু যেন জেনে জানতে চাইছিল।
পূজা অস্ত্যর্থক মাথা নেড়ে থেমে থেমে যন্ত্রণা সয়ে সয়ে বলল, “ওরা তোমায় মারতে এসেছে। তুমি কাকী আর দিদিকে গিয়ে দ্যাখ। শয়তানটা সবকিছু করতে পারে।”
কামিজটা পূজার শরীরে ভাল করে ঢেকে কুড়ুল সমেত তাকে তুলে বস্তীর দিকে পা বাড়িয়ে দামু বলল, “আমি প্রতিশোধ নেবো। আজই। ভগবানের দিব্যি খাই।”
“আমায় এখানে ছেড়ে যাও বাবার কাছে।”
“না, তোমাকে মা’র কাছে ছেড়ে দেবো। তারপর এক একজনকে মারবো।” পা চালিয়ে দামু বলল।
“কিন্তু এসবের পরে আমি যে আর বাঁচতে চাই না দামু।” যন্ত্রণায় আর নিরাশায় পূজা বিহ্বল হয়ে উঠল।
“অমনটা বোলো না। আমি দুর্বল হয়ে যাবো।” প্রচণ্ড আক্রোশে দামুর পা দুটো অন্ধকারের মধ্যেও বেগবান হয়ে উঠল।
***
লাল, সংকট এবং রাসীদ আলি একে একে এসে বিল্টনের সাথে যোগ দিয়েছিল। রাসীদের সাথে আসা দুই যুবক খুকরি নিয়ে বস্তীর দুদিকে পাহারায় ছিল। তাদেরই একজনের দেওয়া খবর রাসীদ বিল্টনকে শোনালো, “ভাই জী, সে শালা বোধহয় পালিয়ে গেছে। সম্পৎ তার বাড়ির পেছন দিয়ে ঢুকেছিল। তার বাপ বোধহয় মারা গেছে। আর তার মা আর দিদি খাটের পাশে ঠায় বসে আছে।”
“ বস্তীর হারামিরা ভাগিয়ে দিয়েছে শুয়োরের বাচ্চাকে। কিন্তু বাপ মরার খবর যদি সে জানে তাহলে এখানেই কোথাও থেকে থাকবে। সব দরজায় আগল দিয়ে পুরো বস্তী জ্বালিয়ে দে। কেউ বেরিয়ে এলে গুলি চালা, কেটে ফ্যাল – কেউ যেন শালা প্রাণে না বাঁচে। দ্যাট ইজ রাইট। শীগগির যা – তাণ্ডব কর।” বিল্টনের এই ভাষণ পূর্ণ আদেশে সংকট আর রাসীদ কালবিলম্ব না করেই ছুটল কয়েক হাত দূরের বস্তীর দিকে। লালকে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিল্টন সরাসরি সন্দেহের প্রশ্নবাণ ছুঁড়ল, “কি রে? শালা তুই তো নোস ‘গদ্দার’?”
অন্ধকারে দেখা না গেলেও লাল শিংএর চোখদুটোর থেকে যেন ক্রোধাগ্নি বিচ্ছুরিত হল। “ভাই জী, আর কেউ যদি একথা বলতো তাহলে আমি তার ‘টেঁটুয়া’ (টুঁটি) টিপে কিংবা তাকে গুলি মেরে যমালয়ে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু ভাই জী আমি আপনাদের ‘নমক’ (নুন) খেয়েছি – আপনাদের দলের সাথে যুক্ত – তা নাহলে আমি হাতিয়ার সরবরাহ যেমন করি চালাতেও তেমন জানি। দামুর পালানোতে আমার কোন হাত নেই। যাই হোক – এসব ছাড় ভাই জী – বস্তিতে আমার বোন থাকে। ওর পেটে বাচ্চা। রাজনীতি অনেকবার এই বস্তীর দিকে আঙ্গুল তুলেও চুপ হয়ে গেছে। আর আজ আমি বলছি – এই বস্তিটা বাদ দাও ভাই জী।”
“নাহলে কি করবি? ‘টেঁটুয়া’ টিপবি? গুলি মারবি? আবে মার না – মার।”
বিল্টনের কথার ফাঁকে পকেটে হাত দিয়ে লাল নিজের পিস্তলটা বার করতে যাবে এমন সময় তার উদ্দেশ্য বুঝে সজোরে এক লাথি মেরে নিমেষে বিল্টন তার বন্দুকটার একটা গুলি লাল শিংএর মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “ময়ূরের পাখায় কাক, শালা।”
আর কয়েক মুহূর্ত পরেই সম্পূর্ণ বস্তিটা ভয়ংকর লেলিহান অগ্নিশিখার কবলে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
এই ক্ষণে বলা বাহুল্য যে এই সংকটরা এক অরাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে এই প্রদেশের এক বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করত এবং এই সংগঠন এক বিশেষ ‘সেনা’র নামে প্রদেশের সর্বত্র কুখ্যাত কিংবা বিখ্যাত ছিল। বিগত কয়েক বছরে এরা এরকম অনেক নৃশংস ঘটনায় বিশেষভাবে অনেক দলিত কিংবা অন্য তথাকথিত নিম্ন জাতির লোকেদের নির্মম হত্যার নজীর রেখেছিল। এর পেছনের কারণ ছিল এদেরই প্রশ্রয়কারীদের মস্তিষ্কের উপজ এক ধারণা যে এই নিষ্পেষিত, নিপীড়িত দলিতরা অন্য এক বিরোধী সংগঠনকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে।
***
কাঁধে ও হাতে কাঠ নিয়ে জুবেদ পুরনো শ্মশানের দিকটার জংগলের বাইরে আসতেই কয়েক মুহূর্ত আগে তার কর্ণগোচর হওয়া গণ্ডগোলের শব্দ এখন করুণ আর্তনাদ বলেই জ্ঞাত হল এবং প্রবল অগ্নির আচ্ছাদনে বস্তিকে ঢেকে যেতে দেখে সে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর ঠিক তখনই তার মাথার বোঝাতে এসে লাগল এক গুলি।
বস্তী দহনে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার আলোকে জুবেদ দৃষ্ট হওয়াতে জগ্গাই হঠাৎ তার ওপর গুলি চালিয়ে ছিল। নিশানা ব্যর্থ হওয়াতে আবার গুলি চালিয়ে জগ্গা আর ছোটে লাল দৌড়ল জুবেদের দিকে আর জুবেদ সব কাঠ ফেলে চীৎকার করে দৌড়ল দামুর দিকে তাকে সতর্ক করার জন্যে। “দামু, পালিয়ে যা। পালিয়ে যা – শয়তানরা – ” সতর্কবাণী শেষ হল না। আধো অন্ধকারে ভয়ার্ত বৃদ্ধের পদক্ষেপ পশ্চাতে ধাবমান হৃষ্টপুষ্ট শয়তানদের পদক্ষেপের সাথে মিল না হওয়াতে তৃতীয় গুলিটা এসে লাগল জুবেদের পিঠের বাঁদিকে। আশে পাশের গাছের ওপর থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গিয়ে অন্য কোথাও বসল।
“রেহেম কর – ইয়া আল্লাহ্। লা ইলাহা ইল্লালাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ …” নিজের ইষ্টদেবতার নাম নিতে নিতে প্রাণ হারাল ধর্মভীরু পরোপকারী নিষ্ঠাবান মুসলমান জুবেদ আলি খান।
***
জুবেদের চীৎকার আর গুলির আওয়াজ দুটোই দামুর কর্ণগোচর হয়েছিল। বস্তুত গুলি লেগে জুবেদকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখেছিল সে। সবকিছু এখনও বুঝে উঠতে না পারা পূজাকে একটা বড় গাছের আড়ালে আলতো করে বসিয়ে ফিস ফিসিয়ে তাকে চুপ থাকতে বলে কুড়ুল সমেত ছুটে গিয়ে সে জুবেদকে ধরে ‘চাচা’ ডেকে নাড়া দিতে দেখল জুবেদ ইতিপূর্বেই হতপ্রাণ হয়েছে। চোখের জলে সবকিছু ঝাপসা হয়ে ওঠার আগেই দড়াম করে আর একটা গুলি চলল। গুলিটা দামুর ঠিক ডান দিকের গাছটাতে লাগল। গাছের আড়ালে আড়ালে লাফ দিতে দিতে শেষ দুটো গুলি থেকে নিজেকে বাঁচানোর পর দামু কুড়ুলটা সবেগে ছুঁড়ে মারল জগ্গার দিকে। অব্যর্থ ভাবে সোজা হয়ে কুড়ুলটার ধারের দিকটা লাগল জগ্গার কাঁধে।
“আর তোরা কেউ বাঁচবি না।” বলে ছুটে গিয়ে কুড়ুলটা তুলে দামু সোজা বসাল তার মাথায়। মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে গোঙাতে লাগল রক্তাক্ত জগ্গা। পেছনে দৌড়ে আসা তার সর্বসময়ের সাথী চাকু ছুঁড়তে ওস্তাদ ছোটে লাল তার চাকুটা ছুঁড়ল বটে কিন্তু দামুর হঠাৎ ঝুঁকে পড়ায় তা তার গা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল।
পূজা উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টায় নড়বড়িয়ে পড়ে গিয়ে তলপেট চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বিলাপ করে বলল, “বাবা, আমি তোমার কাছেই আসবো গো।”
ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে এক লাথি কষল দামু ছোটে লালের পেটে। পাল্টা মার তো দূরের কথা, তাকে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ না দিয়েই কুড়ুলের কোপ বসাল দামু তার বুকের ওপর। একটি ছোট আর্তনাদের সাথেই নিশ্চল হয়ে গেল ছোটে লাল উর্ফ ছুট্কু।
***
বস্তিটা দাউ দাউ করে জ্বলছিল।
অর্ধমৃত প্রায় সদ্য বিধবা রাইমনি মেয়ের সাহায্যে স্বামীর মৃতদেহকে বার করার অসফল প্রয়াসে জ্বলন্ত অগ্নিতে মেয়ে সহ প্রাণাহুতি দিয়েছিল। কয়েকজন যারা সর্বগ্রাসী অগ্নির কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিল তারা গুলি এবং খুকরির আঘাতে শেষ পর্যন্ত মারা পড়েছিল বটে কিন্তু মরতে মরতে খুকরি ধারী দুই যুবককে মরণকামড়ে সঙ্গে নিয়ে পুনর্বার আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল। লাল শিংএর যুবতী অন্তঃসত্ত্বা বোনের স্বামীকে গুলি করে তার সাথে বোঝাপড়া করে সহবাসের ইচ্ছাতে রাসীদ আলি নিজের যৌন অঙ্গে যুবতীর লাথি খেয়ে এবং তার দ্বারা নিজেরই বন্দুকের গুলিবিদ্ধ হয়েও নিজের শেষ শক্তি দিয়ে তার সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে চিরতরে অগ্নিশয্যায় শায়িত হয়েছিল।
লাল শিংএর বউ সহ বাড়ির লোকেরা ছাদের ওপর গুলি গোলার ভয়ে এবং রাজনৈতিক কারণে শোকে মহ্যমান নীরব দর্শক হয়ে চোখের জল ফেলছিল। দূরে মাঠের ওপারে গ্রামবাসীরা জ্বলন্ত বস্তীকে দীপাবলির রাতের আলোকমালার মতো মনে করে একে অপরকে আগুণের বেগ এবং দিশার বর্ণনার সাথে ঘটনাটি ঘটিত হওয়ার স্বচিন্তিত বিভিন্ন কারণ এবং তৎপরবর্তী সম্ভাব্য ঘটনাবলীর ব্যাপারে আলোচনা করছিল।
***
সংকট ফিরে এসে বিল্টনকে সব খবর দিলে পরে ভাড়া করা গুণ্ডাদের মৃত্যুতে কোনরূপ দুঃখ প্রকাশ না করেই দামুর পরিবারের সাথে দলিত বস্তী উজাড় করে দেওয়ার সফলতার আনন্দ উপভোগ করল সে। এখনও যথেষ্ট নেশায় অল্প জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরে আদেশ দিল, “কোন চিন্তা করিস না। এখন সব টাকা তুই পাবি। কাল থানাতে একটা কেস বানিয়ে দেবো। ওই হারামিটাকে আমার চাই। জগ্গা আর ছুট্কু গেছে ওর পেছনে। তুইও যা। ধরে আন। নাহলে মেরে দে শালাকে। আমার অর্ধেক প্রতিশোধ পুরো হয়ে গেছে। দ্যাট ইজ রাইট। তুমিও যাও মুনিম এর সাথে। আমিও আসছি।”
আদেশ শেষ হওয়ার আগেই সংকট জংগলের দিকে চলতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। মুনিম তাকে অনুসরণ করল। পেছনে বিল্টন একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগল।
***
রক্তাক্ত কুড়ুলটা নিয়ে লাথি মেরে বাপের সমান ‘জুবেদ চাচা’র হত্যাকারী শয়তান দুটোর মৃত্যু নিশ্চিত করে হাতে-জামাতে-মুখে রক্তের ছিটে নিয়ে পূজার কাছে ফিরে এল দামু।
“দুটোকে যমালয়ে পাঠিয়েছি। বাকী থাকল দুটো।”
এতক্ষণে সব কিছু বুঝে ফেলা পূজা দামুর স্বস্তিবাক্যের জবাবে কেঁদে উঠে বলল, “খুনিই যখন হলে তাহলে সবাইকে মেরে দাও। কাউকে ছেড়ো না। ঐ দ্যাখ শয়তানরা বস্তী জ্বালিয়ে দিয়েছে।”
এই কয়েকটা ঘণ্টার ব্যবধানে নিজের জীবনের প্রায় সব কিছু হারিয়ে গেছিল বলে দামুর মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন পূজার কথায় জংগলের সীমানার অনতিদূরে শোরগোলহীন দাবানলের মতো লেলিহান শিখার আচ্ছাদনে জ্বলতে থাকা বস্তীটার দিকে তাকিয়ে সে অনুভব করল যে এই মুহূর্তে তার সবকিছু সত্যিই হারিয়ে গেল – বাপ-মা, দিদি –সবকিছু। ‘মা’ বলে হাহাকার করে উঠে ছুটতে যাবে এমন সময় দড়াম করে একটি গুলি এসে লাগল তার বাম কাঁধে। গুলির আঘাতে পেছনের দিকে ছিটকে পড়ে গেলেও মা হারানোর চরম দুঃখে এবং প্রতিশোধের চরম জ্বালায় শারীরিক যন্ত্রণার অনুভূতি তার উবে গিয়েছিল। ভুলে যাওয়া কুড়ুলটা তুলে নিয়ে ছায়ামূর্তির মতো এগিয়ে আসা সংকটের দিকে দৌড়ল সে। সংকট আবার ফায়ার করতে গিয়ে দেখল গুলি নেই তার বন্দুকে। দুই পকেট হাতড়েও গুলি না পেয়ে সে সামনে এগোবে কিংবা পশ্চাৎ গমন করবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ক্ষিপ্র গতিতে লাফিয়ে পড়ে দামু কুড়ুলের এক কোপ বসাল তার ঘাড়ের ওপর। নৃশংস এই হত্যার পর সে যেন মানুষখেকো বাঘের মতো হয়ে গিয়ে গাছের আড়াল নিল।
বস্তী থেকে আসা আলোর থেকেও কম আলো বিশিষ্ট ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়া টর্চটা জ্বালিয়ে মুনিম এগিয়ে আসছিল। পায়ে তার জগ্গার মৃতদেহ ঠেকতেই সে আঁতকে উঠে চীৎকার করল। আর নিমেষে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটে এসে কোপ মারতে গিয়ে দামুর হাত ঢিলে হয়ে যাওয়াতে কুড়ুলের ধারের উল্টোদিকের লোহাটা সবেগে লাগল মুনিমের মুখের ওপর। প্রায় ডিগবাজীর মতো ছিটকে পড়ে গেল সে। দাঁত ভেঙ্গে বেরিয়ে গল গল করে রক্ত ঝরতে থাকল তার মুখ থেকে। দামুর কুড়ুল সামলে আবার তুলে আঘাত করার আগেই পেছন থেকে আসা বিল্টনের বন্দুকের গুলি এসে লাগল তার ডান কাঁধে। কুড়ুল সমেত দামু পড়ল মাটিতে। মুনিমের মুখ থেকে বেরোনো গোঙানির শব্দে দামু ঘষড়ে গিয়ে মুনিমের ওপর কোপ বসিয়ে কুড়ুল ছেড়ে তার গলা টিপে ধরল। “আজ সব পাপীকে আমি নিজের হাতে যমালয়ে পাঠাবো।” দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড ক্রোধে কথাটা বলে ঝটকা দিয়ে মুনিমকে টেনে তুলতেই বিল্টনের দ্বিতীয় গুলিটা সিধে এসে লাগল মুনিমের পিঠে। ইতিপূর্বেই মরে যাওয়া মুনিম তার অগণিত পাপের ফল হিসেবে নিজের মালিকের গুলি খেয়ে যেন আর একবার মরে দামুকে বাঁচিয়ে দিল। কাছে এগিয়ে আসা বিল্টনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল দামু।
“আজ তুই মরবিরে আমার হাতে, শুয়োরের বাচ্চা।” কথাটা টেনে টেনে বলে বিল্টন তৃতীয় গুলিটা চালাতে যাবে তার আগেই দামু তীব্র গতিতে কুড়ুলটা উঠিয়ে ছুঁড়ে মারল তার দিকে। এবারে কুড়ুলটা সজোরে বিল্টনের পায়ে গিয়ে লাগল বটে কিন্তু বাঁটের দিকটা। বন্দুকটা তার ছিটকে পড়ল একটু দূরে। তাকে বন্দুক ওঠানোর সুযোগ না দিয়েই ছুটে গিয়ে ষাঁড়ের মতো মাথা দিয়ে গুঁতোল দামু। তারপর এক লাথি কষে বলল, “কাল দেখবে পুরো দুনিয়া যে গরীব যদি মাথা তুলে দাঁড়ায় তাহলে তাদের ওপর অত্যাচারকারীদের কেমন সর্বনাশ হয়ে যায়।”
কথাটা শুনতে শুনতে মাটিতে পড়ে যাওয়া বিল্টনের হাতে লাগল ছোটে লালের চাকুটা। দামুর দ্বিতীয় লাথি মারার সময় চাকুটা সে সোজা ঢুকিয়ে দিল দামুর পেটে। লাথিটা সজোরে মাঝপেটে পড়াতে বিল্টন ব্যথায় ককিয়ে উঠে চাকুর বাঁটটা ছেড়ে দিল। দামু যন্ত্রণা সহ্য করে চাকুটা নিজের পেট থেকে দ্রুত টেনে বার করে উবু হয়ে উঠে পড়া বিল্টনের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নাড়া দিতে থাকল। মায়ের আর দিদির জ্বলন্ত দেহের কল্পনায় ক্রুদ্ধ দামু চাকুর বাঁটটা যত নাড়া দিল বিল্টন অসহ্য যন্ত্রণায় তত চীৎকার করতে থাকল। একটুক্ষণেই বিল্টনের কাতর হয়ে পড়াতে চাকুটা বার করে দামু সোজা আঘাত করল তার বুকের ওপর। তারপর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠা বিল্টনের বুকের ওপর হাঁটু রেখে তার গলা টিপে ধরল সে। ক্ষণিক পরে সর্বশেষ শত্রুর মৃত্যু সুনিশ্চিত করে উঠে দাঁড়িয়ে ম্রিয়মাণ অগ্নির কবলে প্রজ্বল্যমান বস্তীর দিকে তাকিয়ে হাহাকার করে কেঁদে উঠল সে। আর তখনই তার সর্ব শরীরে অসহ্য ব্যথার অনুভূতি হল। ধীরে ধীরে স্খলিত পদক্ষেপে পূজার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এগোতে লাগল সে।
পূজা ইতিপূর্বে আর একবার উঠে দাঁড়ানোর অসফল চেষ্টা করে ঘষড়ে ঘষড়ে যন্ত্রণা কাতর শরীর নিয়ে দামুর দিকে এগোচ্ছিল।
আর পূজার দিকে এগোতে এগোতে দামুর পায়ে কিছু একটা ঠেকতেই নিচের দিকে তাকিয়ে পা দিয়ে নাড়িয়ে অনুভব করে সেটাকে তোলার জন্যে ঝুঁকতেই নিজের শরীরের ভার ধরে রাখতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। ব্যথায় ককিয়ে উঠে মাটিতে হাত বুলিয়ে যেটা ওঠাল সেটা ছিল বিল্টনের বন্দুক। সেটা খুলে দেখে একটু ক্ষণের জন্যে কিছু ভেবে করুণ মুখে সেটা নিয়ে ঘষড়ে ঘষড়ে এগোতে লাগল।
পূজার কানে দামুর কণ্ঠস্বর গেলে পরে সে যন্ত্রণা কাতর কণ্ঠে দামুর নাম ধরে ডেকে সাড়া দিল। কাতরাতে কাতরাতে দুজনে মাটি বেয়ে বেয়ে এক গাছের নীচে একে অপরের এক বাহু দূরত্বে আসতেই দামু বন্দুকটা লুকিয়ে অতিকষ্টে নিজে উঠে গাছটায় হেলান দিয়ে বসে পূজাকে তুলে নিজের পাশে বসালো। সক্লেশে উঠে বসতে বসতে পূজা নিজের হৃদয়ের গভীরে এতক্ষণ জমা হওয়া অনেক কাল্পনিক শঙ্কা দূর করার নিমিত্ত প্রশ্ন করল, “তুমি ভাল আছ তো?”
রক্তাক্ত দেহে ক্ষীণ হয়ে আসা শক্তিকে পুনঃ একত্রিত করার অসফল প্রয়াসের সাথে দামু পূজার প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, “সবাইকে মেরে দিয়েছি। আর কেউ বেঁচে নেই। এমন অত্যাচার করল শয়তানরা বাপের চিতাও জ্বালাতে পারলাম না। তাদেরই লাগানো আগুনে আপনাআপনিই বাপ পুড়ে গেল। মা সেই আগুনে সতী হয়ে গেল – বোনও জ্বলে গেল। আমি কিছুই করতে পারলাম না। আর আমার বেঁচে কোন লাভ নেই।”
অশ্রুসজল প্রতিবাদ এল পূজার রুদ্ধ কণ্ঠ থেকে। “না-না, অমনটা বোলো না। তোমায় বাঁচতে হবে। মরবো তো আমি। এই কলঙ্কের ভার আমি বইতে পারবো না। তুমি আমায় মুক্তি দাও এই দুর্বিষহ জীবন থেকে। টিপে দাও আমার গলা। তোমার হাতে মরলে আমি শান্তি পাবো। নাহলে আমায় আত্মহত্যা করতে হবে।”
ইতিপূর্বেই দৃঢ় নিশ্চয় করে ফেলা দামুর মুখ থেকে বেরোল বিরোধাত্মক যুক্তি, “আর আমি কার জন্যে বাঁচবো? ফাঁসিকাঠে চড়ার জন্যে?”
“তাহলে চল আমরা দুজনেই মরি একসাথে। – জবাব দাও না কেন? ” নির্বাক দামুর দিকে চেয়ে দুগাল ভেসে যাওয়া অশ্রুজলের সাথে রুদ্ধ কণ্ঠে শেষ প্রশ্ন করে চুপ হয়ে রইল পূজা।
“তাই হবে। আমরা দুজনেই একসাথে মরবো।” সমানে বেয়ে যাওয়া চোখের জলের সাথে দামুর ঠোঁট দুটোতে এক শুকনো ব্যথার হাসি এসে থেমে গেল। পূজাকে সে আলতো করে বাঁদিকে নিজের বুকে টেনে নিল। ডান হাতে বন্দুকটা বার করে প্রানাহুতির চরম আত্মিক প্রস্তুতি নেওয়া পূজার বুকের কাছে নিয়ে গিয়ে অঝোর ঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তার কপালে চুমু খেয়ে বন্দুকের ট্রিগারটা টিপল সে।
আশ্রয়দাতা গাছটার ওপর থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল।
তারপর পূজার স্পন্দনহীন হয়ে যাওয়া দেহটা নিজের কোলে শুইয়ে নিয়ে বন্দুকটা নিজের কানের নীচে রেখে আর একবার – শেষবারের মতো ট্রিগারটা টিপল দামু।
কাছে পিঠের গাছগুলো থেকে শেষ কয়েকটা পাখি পাখনা ঝাপটে মাঝ আকাশে উঠে আসা কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর চাঁদের দিকে উড়ে কোথাও চলে গেল।
*****
পরিশিষ্ট
পরদিন প্রভাতে সূর্যদেব অনেকটা উঠে আসতে কানে কানে খবর হওয়াতে পুলিশ তদন্ত করতে এসেছিল। রাজনৈতিক চাপে এই নির্মম ঘটনাকে ব্যক্তিগত আক্রোশের পরিণাম স্বরূপ ঘোষিত করে দেওয়া হয়েছিল। সমস্ত রাজনৈতিক দল এর তীব্র নিন্দা করাতে পরের দিন স্থানীয় খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছিল এই ঘটনার ভ্রংশিত বিবরণ। দিন তিনেক পরে এক আধটা বড় কাগজের কোণায় অতি ছোট খবর হয়ে তা প্রকাশিত হয়েছিল।
দেবু উরফ দেবনারায়ন সেই রাতে সোজা ষ্টেশন গিয়ে ধীর গতিতে প্লাটফর্ম ছেড়ে যাওয়া এক ট্রেনে বিনা টিকিটে উঠে পড়ে জেনেছিল গাড়িটা হাওড়াগামী। অতঃপর তার আর কোন খবর কেউ পায়নি।
১৯৯৭ থেকে আরম্ভ করে ২০০০ সাল পর্যন্ত এইরকম অনেক নির্মম হত্যাকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীদের জেলা আদালতে ২০১০ সালে ফাঁসীর সাজা হলেও প্রদেশের উচ্চ ন্যায়ালয় ২০১৩ তে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য সবুতের অভাবে তাদের মুক্ত করে দিয়েছিল। সারা ভারতে এইরূপ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এর বিধান হবে কেমন করে আর কবে?
– সমাপ্ত –