ধারাবাহিক উপন্যাস
হকের পয়সা চাইতে গিয়ে বনবারি আর জুবেদ মার খায় ভাঁটা মালিক রত্নাকরের হাতে। ভুল ইংরেজি বলে, টাকার আর মদের লোভ দেখিয়ে পূজাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে বিল্টন সিং পটিয়ে নেয় পূজার বাবা বদ্রীনাথকে। ক্রোধ মাথায় তুলে দামু বিল্টন কে পিটিয়ে দেওয়ার মন্তব্য করে।
এর আগে –
বাহুবল, ছল আর নিঃসহায়তা
পূজাও দাঁড়িয়ে পড়ে তাকে থামিয়ে বলল, “না, তুমি কিছু করবে না। বাবা আমাকে নিশ্চয়ই বলবে আমার বেরিয়ে আসার পরে কি কথা হয়েছে। নির্লজ্জটা বিয়ের প্রস্তাব দিলেও বাবা নিশ্চয়ই এত শীগগির ‘হ্যাঁ’ করবে না। একটু সময় যেতে দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বাড়ি যাও। আর কাল কাজে যেও।”
সুবোধ বালকের মতো মাথা নেড়ে এগোয় দামু।
“ আর শহরের কথাও মনে রেখো,” পেছনে চলতে চলতে পূজা বলল।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দামু দেখল পূজার সুন্দর গোলাপি ঠোঁট দুটো যেন মুচকি হেসে অন্য কথা বলতে চাইছে। অভ্যেস বশত আজও চুল বাঁধেনি সে। কোন্ পার হতে আসা এক দমকা হাওয়াতে কোমর ছাপানো চুলের একরাশ এলিয়ে গেল তার উন্নত বক্ষস্থলে। শব্দহীন কথা কওয়া চোখদুটো তার যেন হাতছানি দিয়ে ডাকল দামুকে। মাথায় উঠে আসা দুপুর রোদের ঘোরে দামু হাত ধরে কাছে টেনে নিল পূজাকে। চাইল নিজের ঠোঁট দুটো পূজার প্রতীক্ষিত অধর যুগলে ছুঁইয়ে সদ্যজাত প্রছন্ন আবেগের নিঃশব্দ আদান প্রদান করতে। কি এক অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষায় পূজার সর্বশরীরে হঠাৎ বয়ে যাওয়া পরিচিত এক শিহরণে তার চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসাতে মাঝ আকাশের উন্মুক্ত প্রজ্বলিত সূর্যটা যেন তার মেঘে ঢাকা বলে মনে হল। এক পলকের অপেক্ষা এখন তার অনেক দণ্ড-প্রহরের সমান মনে হল।
দামুও তার মনের ভেতর জেগে ওঠা ইচ্ছেকে পরিতৃপ্ত করার প্রয়াসে দ্বিতীয় পদক্ষেপের জন্যে অগ্রসর হতেই কোথা থেকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এক পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
“এই দ্যাখ, বড় বোন হাড়জ্বলা দুপুরে তার যৌবন শুকিয়ে দিচ্ছে আর ভাইকে দ্যাখ প্রেমের সমুদ্রে ডুবে গরম যৌবন ঠাণ্ডা করছে।”
মাথা ঘোরাতে দামুর নজরে পড়ল বিল্টন সিংহের দুই চ্যালা। পূজার হাত ছেড়ে এগিয়ে গেল সে দুজনের দিকে। চ্যালা দুটিও কম যায় না। পা-পা এগিয়ে এল দামুর দিকে।
“কিরে? কালকের কথা ভুলে গেলি?”
গুন্ডা প্রকৃতির চেলাটার এই ধমকির সমর্থনে মিশ্র প্রকৃতির দ্বিতীয় চেলাটি বলে উঠল, “ আর একবার মনে করিয়ে দিতে হবে নাকি?”
“কি মনে করাবিরে, হারামি?” কথাটা দামুর বলার সঙ্গেই পূজার কণ্ঠস্বর তার কানে এল। “দামু, আজ শিক্ষা দাও এদের। কিছুতেই ছেড়ো না।”
নিমেষে দামু সপাট এক ঘুষি মারল মিশ্র জীবটাকে। টাল সামলে পাল্টা আঘাত করার আগেই আরও একটা ঘুষি আর লাথি একসঙ্গে খেয়ে ধরাশায়ী হল হাস্য চরিত্রটি। বলা বাহুল্য ঐ ‘যৌবন’ ইত্যাদি টিপ্পনীটি এই ব্যক্তিরই ছিল। দ্বিতীয়টির এগিয়ে আসাতে দামু মুহূর্তের মধ্যে হাত চালালেও নিজেকে বাঁচিয়ে সে পাল্টা আঘাত করল দামুর ওপর। কালকের বদলা নিতে তৎপর দামু উপর্যুপরি দুটো ঘুষি তার মুখের ওপর চালাতেই মুখ দিয়ে তার রক্ত বেরোল। তাকে কোন সুযোগ না দিয়েই এবারে এক লাথি কষল দামু। লাথি খেয়ে এক গাছের ওপর মুখ ঠুকল তার। শক্তিমান সাথীটি মার খাচ্ছে দেখে রসিকটি মাটি ধরে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করেই পালিয়ে বাঁচল। আর তাকে পালাতে দেখে এবং নিজের দুরবস্থার দিকে খেয়াল করে দ্বিতীয়টিও পড়ি কি মরি করে দিল ছুট।
পূজার হাত নেড়ে ছেলেমানুষের মতো “ঠিক হয়েছে – ঠিক হয়েছে” বলাতে দামু মনে প্রশান্তি এনে দুহাত দিয়ে নিজের মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে তাকে সাথে নিয়ে মেঠো রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
***
মাথার ওপরে রাখা থাক ইটের বদৌলতে সন্ধ্যার ঘর্মাক্ত মুখখানা স্বল্প দূরত্বের জন্য হলেও ছায়ার আশ্রয় পাচ্ছিল। রামদীনের নজর বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত হওয়ার পর ক্লান্তিতে পিছিয়ে পড়া সন্ধ্যার উপর গিয়ে পড়তেই এদিক ওদিক তাকিয়ে উঁচু করে রাখা কাঁচা ইটের থাকগুলোর পাশ দিয়ে হয়ে সে এসে পড়ল সন্ধ্যার সামনে। উত্তপ্ত দুপুরের মাদকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে সন্ধ্যার পরিচর্যা হীন সৌন্দর্যকে চক্ষু দ্বারা অনধিকার সম্ভোগ করে নীচুস্বরে ভূমিকা করল সে, “কেন তুই এত খাটিসরে? কখনো একটু আরামও করে নে এক কোণে। আমিও তোর সাথে – ”
সূর্যের তাপ এবং রামদীনের অস্বীকার্য টিপ্পনী সন্ধ্যার কপালে ভাঁজ টেনে দিল। চরম বিরক্তির স্বর বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে, “কেন আমার পেছনে পড়ে থাকিস? নিজের কাজ করগে যা না।”
পাশে কারুর ফেলে যাওয়া চার পাঁচটা ইটের একটা তুলে নিয়ে চোখের ইশারায় জবাব দিল রামদীন, “ কাজই তো করছি।” আর বলেই ইটটা পাশের থাকে রাখল।
ডান হাতে মাথার ভার সামলে বাঁহাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল থেকে চুয়ে আসা চোখজ্বলা ঘাম মুছে মাথার ওপর থেকে ইটগুলো সামনের থাকে সাজাতে সাজাতে রোষ ব্যক্ত করল সন্ধ্যা, “ হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি কত কাজ করিস আর কিরকম করিস। সকালে নিজের মাইনে বার করাবার জন্যে বনবারী কাকা আর জুবেদ চাচাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে কেটে পড়লি। ইস্! কি খারাপটাই যে হল ওদের সাথে! আর তুই তো – ”
হাতে আর একটা ইট তুলে নিয়ে ফোড়ন কাটল রামদীন, “ কেন অন্যের কথাতে নাক গলিয়ে নিজের মাথা খারাপ করিস? দ্যাখ –”
“আমায় কিছু দ্যাখাতে হবে না – বুঝলি? আর শোন , ভাই যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তোর মনে কি রয়েছে তাহলে, সত্যি বলছি, সে তোর অবস্থা খারাপ করে দেবে। রাস্তা ছাড়।” ইট রাখা হয়ে গিয়েছিল বলে সোজা ফেরৎ গেল সন্ধ্যা।
ক্ষণভর চুপ থেকে হাতের ইটটা থাকের দিকে তুলেও ওখানে না রেখে নীচে ফেলে দিয়ে দূরে চলে যাওয়া সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে রাগ এবং আফসোস মিশিয়ে ঠোঁট কুঁচকে চাপা গলায় বলে উঠল রামদীন, “নখরা দেখ শালীর!”
***
খাটের ওপর শুয়ে হরিরাম শূন্যদৃষ্টিতে আসবাবহীন ঘরের এক কোণার দিকে তাকিয়ে বোধহয় নিজের জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেবের গরমিল খুঁজছিল। ভেতরের দরজা দিয়ে শাড়ির এক কোণ ছেঁড়া আঁচলে ধরা গরম তেলের বাটি নিয়ে প্রবেশ করা রাইমনির শ্লেষোক্তি হরিরামের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করল।
“একেবারেই নিকম্মা করে দিচ্ছ ছেলেকে। লজ্জা-শরম হাটে বেচেছে যেন। বড় বোন মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে আর জোয়ান ভাইকে দেখ – উল্টোপাল্টা সব বেমতলবের কথা।’’ শেষের ক’টি কথা বলতে বলতে বাটিটা বিছানার ওপর স্বামীর পাশে রেখে তিন আঙ্গুল তাতে ডুবিয়ে গরম তেল নিয়ে লম্বা টানে তার হাত মালিশ করতে আরম্ভ করল রাইমনি।
“ছেলে বড় হয়ে গেলে তাকে বুঝিয়ে বলতে হয় নাকি তোর মতো – ”
“চুপ করো। তুমিই মাথায় উঠিয়েছ। নিজে তো পড়ে থাক – ছেলেকেও অকেজো করে দিচ্ছ।” রাইমনির মালিশের হাত জোরে চলতে আরম্ভ করে।
এক শ্বাসে হরিরাম এক হাত নেড়ে বলে উঠল, “তোর এই হাড়জ্বালানো কথা শুনে শুনে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেল। ছেড়ে দে – এসব আমার চাই না। ” শেষ করার আগেই ভগ্নকণ্ঠে কাশির উদ্রেক হল হরিরামের।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ – সত্যি কথা তো তেতোই লাগবে। কত সহজে বললে যে ‘এসব আমার চাই না’, আরে ‘এসব’ নাহলে এতদিন প্রাণে বাঁচতে কি?” হাত ছেড়ে পা মালিশ শুরু করে তিক্ততার চরম সীমা ছুঁ’ল রাইমনি। “সবার চিন্তার কারণ তো তুমি হলে গো।”
“কোন পোড়ারমুখো বাঁচতে চায়? এই জীবনের থেকে তো মরণই -” কাশির চোটে শেষ করতে না পেরে মাথা নেড়ে রয়ে যাওয়া অভিব্যক্তির পরিস্ফুটন করতে গেলেও অসফল হয়ে বেরিয়ে আসা চোখদুটো নিয়ে হাঁপানির কাশি কাশতে লাগল হরিরাম।
হতচকিত রাইমনি খাটের ওপরেই একটু সরে বসে আসন্ন অশুভের ভীতিতে বিব্রত ভাবে স্বামীর বুকের ওপর হাত বুলোতে বুলোতে তাকে শান্ত হতে বললে পরে সে বাঁ হাত ঝটকে দিল। শ্বাস যেন তার রুদ্ধ হয়ে আসছিল। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্বরিত গতিতে খাট থেকে নেমে ওষুধের খালি পাতাওয়ালা বাক্সটা থেকে হাঁপানি থামানোর পাম্পটা নিয়ে উঠে এসে স্বামীর মাথাটা ধরে তার না বন্ধ হওয়া মুখের ভেতর পাম্পের মুখটা ঢুকিয়ে দু’বার চাপ দিতেই রাইমনি দেখল পাম্পটাও শেষ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “হে ভগবান!” কিন্তু তাতেই হরিরামের স্বল্প উপশম লক্ষ্য করে রাইমনি প্রথমবার স্বান্তনাবাক্যের প্রয়োগ করে বলে উঠল, “না-না, শান্ত হও গো একটুখানি।”
হরিরাম চোখ আর কপাল কুঁচকিয়ে কাঁদ কাঁদ মুখ নিয়ে কাশি চাপার চেষ্টা করে যেন কিছু বলতে চাইল ঘৃনাচ্ছলে।
দুঃখ, লজ্জা এবং চিন্তার সংমিশ্রণে উৎপন্ন এক অব্যক্ত প্রতিক্রিয়ার সাথে চোখদুটো ছল ছল করে ওঠাতে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করতেই কর্কশ কণ্ঠী রাইমনির দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল তার দারিদ্রে দোমড়ানো গালের ওপর। আর ঠিক তখনই বাইরের থেকে প্রতিবেশীর ছোট মেয়ে মুন্নির গলা ভেসে এল। “কাকী – কাকী।”
রাইমনির শাড়ি দিয়ে চোখের জল মোছার আগেই বারো বর্ষীয়া মুন্নির খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করাতে হরিরাম যেন কাশি চেপে মুখে হাসি আনতে চাইল।
“কি হয়েছে কাকী? কাকার শরীর খারাপ মনে হচ্ছে।”
রাইমনি এবার ওষুধের বাক্সের খালি পাতাগুলো টিপে টিপে তাদের মধ্যে থেকে একটা বড়ি খুঁজে বার করতে করতে মুন্নির কৌতূহল মেটাল, “হ্যাঁ, এখুনি এখুনি কাশি উঠল।।”
হরিরাম কাশির রেশ টুকুর সাথে স্বভাবজনিত শান্ত গলায় নিজের অসহায় বোধ জ্ঞাপন করে বলল, “কিছু না রে। রোগগ্রস্ত শরীর তো খারাপই থাকে।’’
পুরনো ষ্টীলের গ্লাসে জল নিয়ে খাটের পাশে এসে স্বামীর উদ্দেশ্যে স্বভাববিরুদ্ধ কোমল স্বরে রাইমনি বলল, “কথা বলো না। আবার কাশি হবে যে।” তারপর মুন্নির উদ্দেশ্যে বলল, “মুন্নি, তোর আম্মিকে একটু ডেকে আন না।”
“আম্মিই তো তোমায় ডাকছে। তাই তো আমি এসেছিলাম বলতে।”
বড়িটা হরিরামকে খাওয়াতে খাওয়াতে রাইমনি বলল, “আচ্ছা, তাহলে তুই একটু কাকার কাছে বস। আমি চট করে তোর মার সাথে দেখা করে আসি।”
মুন্নি খাটের পাশে গোল করে গুটান দাঁড় করিয়ে রাখা মাদুরটা টেনে নিয়ে নীচে বসতে বসতে বলল, “জী – কাকী।”
যথাস্থানে গ্লাসটি রেখে চিন্তাগ্রস্ত ভাবে রাইমনি ব্যস্ততার সাথে বেরিয়ে একটু এগোতেই দেখতে পেল উল্টোদিক থেকে মুন্নির মা আসছে। স্বাস্থ্যের তারতম্যের কারণে বয়সে দুবছর বড় মুন্নির মাকে রাইমনির থেকে একটু কমবয়সী দেখালেও তার পরনের শাড়িটা থেকে তাদের আর্থিক তারতম্য শূন্য বলে প্রতীত হচ্ছিল।
“ভাল হল দিদি তুমি চলে এলে।” রাইমনির উৎকণ্ঠা জনিত বাক্যটি মুন্নির মাকে একটু আশ্চর্যে ফেলে দিল।
“কেন? কি হয়েছে?”
“দামুর বাপুর হঠাৎ কাশি উঠেছিল। ওষুধ সব শেষ হয়ে গেছে। তোমার কাছে দিদি – যদি – বলতে তো লজ্জা করে কিন্তু অন্যের কাছে চাওয়ার থেকে যাদের ওপর অধিকার আছে তাদের কাছে চাইলে – ” একনাগাড়ে রাইমনি কথাগুলো বলে মুন্নির মা’র দিকে তাকিয়ে দেখল তার উৎসুক চোখদুটো নিষ্প্রভ হয়ে গেছে আর তার বন্ধ মুখটা বাঁকা হয়ে এক সদ্যজন্মা হতাশার পরিস্ফুটন করছে।
“কি হল দিদি?” রাইমনির কৌতূহলী প্রশ্ন।
ভরদুপুরের শুষ্কতার সাথে মেলানো শুকনো হাসি হেসে মুন্নির মা তার হতাশার কারণ ব্যক্ত করল, “না, তেমন কিছু নয়। অবস্থার দাস হয়ে আজ আমরা একে অন্যের কাছে হাত পাততে বেরিয়ে পড়েছি। আমি বলতে এসেছিলাম দামু দোকানওয়ালাকে বলে যদি আরও কিছু ধারে জিনিষ পাইয়ে দিত। ঘরে সব জিনিষই বাড়ন্ত। ‘দেবরজী’র সামনে বলতে চাইছিলাম না – তাই – যাক, সে যা হোক, তুই ‘দেবরজী’র ওষুধ যোগাড় কর আগে।”
ইতস্তত বোধ করে রাইমনি কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ সচেতন হয়ে হারিয়ে যাওয়া তৎপরতা ফিরিয়ে এনে মুন্নির মা’র জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তর দিল, “দিদি, মুন্নিকে আমি বসিয়ে এসেছি তার কাকার কাছে। তুমি একটু দেখো।”
“তুই চিন্তা করিস না। আমি আছি, তুই যা।”
“আমি এই গেলাম আর এই এলাম,” বলেই গরম হাওয়ার নিস্তব্ধ দুপুরে দলিত বস্তির সঙ্কীর্ণ গলির মধ্যে দ্রুতপায়ে ঢুকে অদৃশ্য হল রাইমনি।
দারিদ্রসীমার নীচের এই দুই প্রৌঢ় মহিলার বার্তালাপের সমাপ্তি হল দামুর ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়া মুন্নির মায়ের এক স্বগতোক্তির সাথে, “গরীবের এই টানাপড়েন কখনো ঘুচবে কি?”
***
দামুর গ্রাম থেকে প্রায় চার মাইল অর্থাৎ সাড়ে ছয় কিলোমিটার দূরে এক ছোট শহরের (কসবা) এক প্রান্তে চতুর সিংহের দেশী মদের আড্ডাটা গরম হত সন্ধ্যের পর। কিন্তু এখন এই অসময়েও পাঁড়মাতালদের দু এক জনকে টলটলে অবস্থায় আধো-অন্ধকার কোণায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। আসলে দিনের বেলায় যা চলত তা হল জুয়া।
সারিবদ্ধ দোকান গুলোর সামনে দিয়ে খালি গায়ের ঘাঘরা পরা লম্বা চুলওয়ালা এক অর্ধবয়সী পুরুষ নিজের নগ্ন পিঠে ছোট পটকা ফুটার মতো শব্দের সাথে নকলি চাবুক কষতে কষতে নাচছিল। শীর্ণকায় তার স্ত্রী তার পেছন পেছন ছোট একটা ঢোলে কাঠি ঘষে ঘষে অনর্গল এক একঘেয়ে গোঙানির ধ্বনি সৃষ্টি করতে করতে ভিক্ষে চাইছিল যেরকমটা বেশীরভাগ গুজরাত এবং মহারাষ্ট্রে দেখা যায় এবং তারা এদের বলে ‘কড়কলক্ষ্মী’। রোদ জ্বলা দুপুরের স্বল্প ভিড়ের স্ত্রীপুরুষরা অনধিক ব্যস্ততার সাথে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলের দিকে আসা-যাওয়া করছিল।
দূরে এক বুলেট মোটরসাইকেলে চেপে প্যান্টের ওপর রঙ্গিন ছাপ ছাপ পাঞ্জাবি পরা বিল্টন সিংহ এসে চতুর সিংহের আড্ডায় ঢুকল। বলা বাহুল্য তার অশেষ গুণের মধ্যে জুয়ার ব্যাপারটা পরিচিত কারোরই অজ্ঞাত ছিল না এবং তার বর্তমান এই পোশাকের অর্থ সে জুয়া ও বাইজী নাচ উভয়ের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।
***
নিজের বাড়ির বাইরের ঘরে বসেই নির্দ্বিধায় মদ্যপান করছিল বদ্রী। নেশাটা দিনের তাপমানের সাথে মেল খাইয়ে চড়েছিল ভালই। রঙ্গিন মনে সামনে রাখা বোতলটা উঠিয়ে, নাড়িয়ে অনুভব করে সে এই সিধান্তে পৌঁছুল যে ওটা খালি। গ্লাসে আগের ঢেলে নেওয়া পেগটির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটু বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল সে। আর ঠিক তখনই খোলা দরজা দিয়ে রাস্তার পাশের গেট পর্যন্ত তাকাতেই তার মাতাল মনের মধ্যে এক শিহরণ উৎপন্ন হল। এখনও বাঁচিয়ে রাখা সুডৌল যৌবনের সন্ধ্যা কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে চলে আসছে দেখে আবেগবশত মনে মনেই বলে উঠল সে, “এবারে ভরবে রং আমার বেরঙ জীবনে।”
খোলা দরজা দিয়ে সন্ধ্যাকে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখে অনেক আদর-চুম্বনের বহু কল্পিত খেলা মনের মধ্যেই খেলে নিয়ে টাল সামলে উঠে “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না” বলে যেই তাকে জড়িয়ে ধরতে যাবে অমনি হাত ঝটকে দূরে ছিটকে দাঁড়াল দীর্ঘকাল আগে দারিদ্রের কারণে সময়ের পূর্বেই যৌবন হারানো প্রৌঢ়া রাইমনি।
“এ কি করছেন বাবু?”
মদমত্ত কামান্ধ চোখদুটোর ওপর থেকে ভ্রমপূর্ণ আবেগের পর্দা উঠে গেলে পরে রাইমনির তীব্র অসন্তোষ দৃষ্টির দিকে চেয়ে অস্বস্তিতে মুখ, কপাল এবং ভ্রু কুঁচকে নিল বদ্রী। অতি সংকটের সমস্ত বাধ্য বাধকতা ভুলে গা ঘিন ঘিন করা রাইমনির মুখ থেকে বেরোল তিরস্কার বাক্য। “ছিঃ বাবু! মদের ঘোরে এত নীচ হয়ে গেলেন?”
এক আধ দিন সকাল সকাল রাইমনির জায়গায় সন্ধ্যা এসে ঝাড়ু-বাসনের কাজ করে পূজার সাথে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে যেত। বদ্রীর মনের ভেতর তখন কেমন যেন একটা তোলপাড় হত। সেটা সে সর্বদা নিজের মনের ভেতরেই রেখেছিল। কিন্তু আজ ভুলবশত এইরকমটা হয়ে যাওয়াতেও সে কথা সে বলতে পারল না। এখন অপমানবোধ হওয়ার বদলে যেন নেশাভঙ্গে ক্রোধ উঠল তার তুঙ্গে।
“হ্যাঁ, হলাম এত নীচ। ব্যস? কিন্তু তুই এই অসময়ে কেন এসেছিস, জানিস যখন এই বাড়িতে একটা মদখোর থাকে? অ্যাঁ?”
“গরীবের মজবুরি টেনে এনেছে, বাবু। এই মজবুরি গরীবকে সময় অসময় যে কোন জায়গায় যাওয়ার জন্যে বাধ্য করে বাবু।”
“যেমনটা তোর ব্যাটা বাধ্য হয় আমার মেয়েকে বরবাদ করার জন্যে? তুই নিজে এখানে কাজের অছিলায় আসিস আর ওদিকে ছেলেকে লাগিয়ে দিস পূজার পেছনে? তোরা গরীব নোস তোরা হচ্ছিস চালাক।” ভাবার্থ যা’ই হোক না কেন সকালে বিল্টনের ফুঁ দিয়ে যাওয়ার দরুন আক্রোশ বশত আর নিজের বর্তমান দোষ ঢাকার দ্বৈত উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে গেল বদ্রী।
ছলছলে চোখে প্রসঙ্গ এড়িয়ে করুণ বিনতি করল রাইমনি, “যা বলার বলুন বাবু। আমি স্বামীর ওষুধের জন্যে পয়সা চাইতে এসেছিলাম। কিছু অগ্রিম পয়সা দিন বাবু। আমার স্বামীর –”
“কোন পয়সা-টয়সা হবে না। দূর হয়ে যা এখান থেকে। আর শোন – কাল থেকে কাজে আসবি না।।” রাগের চোটে নেশা যেন অর্ধেক বদ্রীপ্রসাদের।
“দয়া করুন বাবু – এত কঠোর – ”
“কোন দয়া-টয়া হবে না। আর শোন –” দূর থেকে চলে আসা পূজাকে বোধহয় আবছা দেখতে পেয়েছিল বদ্রী। দ্বিত্ব করে শুনিয়ে বলার চেষ্টা করল বদ্রী, “হ্যাঁ – শোন, তোর ছেলেকে বলবি আর যেন –”
ছেলের কথা পুনরায় উঠতেই চোখের জল মুছে রুখে দাঁড়াল রাইমনি। “অনেক হয়েছে বাবু। তালি এক হাতে বাজে না। নিজের মেয়েকে বোঝান। আত্মসম্মানের ধোস জমানো খুব সোজা কিন্তু স্বভাবের ওপর কাবু পাওয়া খুবই মুশকিল, বাবু।”
চৌকাঠে পা দিয়েছিল পূজা। রাইমনির সবটাই তার কানে গেল।
মাথা ঝাঁকিয়ে পূজার দিকে কটাক্ষ হেনে রাইমনিকে শাসাল বদ্রী, “ব্যস, বন্ধ কর ভাষণ। বেরিয়ে যা। আমি আমার মেয়েকে দেখে নেবো আর তোর ছেলেকেও। নেশা জল হয়ে গেল।”
রাইমনি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল পূজাকে।
রাইমনির পরিবারের সবাই জানতো দামু-পূজার সম্পর্কের কথা। পূজার জিদেই ওরা ওকে মেনে নিয়েছিল এবং কাউকে কিছু বলেওনি। কিন্তু এই মুহূর্তে আর তার সাথে সুখদ বার্তালাপের ধৈর্য রাখল না রাইমনি। পাশ কাটিয়ে যেতে চাওয়াতে তাকে কিন্তু বাধা দিল পূজা।
“দাঁড়াও কাকী। আমি একটা কথা বলতে চাই। সকালে বাবাকেও বলেছি আর এখন তোমায় বলতে চাই -”
অবিশ্বাসের দৃষ্টি রাইমনির চোখে। মেয়ের ঔদ্ধত্যে বিস্মিত বদ্রী মুখ হাঁ করে শুনছিল।
“আমি দামুকে ভালবাসি আর দামু আমাকে। আমাদের বিয়ে যদি না হয় কিংবা দামুর যদি কিছু হয় তাহলে আমি আত্মহত্যা করে নেবো।”
পূজার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাইমনি দরজা পার করে অপেক্ষাকৃত উচ্চ স্বরে বলতে বলতে গেটের দিকে যেতে থাকল, “দামুর আবার কি হবে? আরে ভীষণ আগুন আছে ওর মধ্যে। শুধু ওপরে গরিবির ছাই চাপা পড়েছে মাত্র। কোনোদিন সেই আগুন যদি বাইরে আসে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সর্বনাশ।”
রাইমনির কণ্ঠস্বর ম্লান হয়ে যাওয়ার আগেই দরজার বাইরে এসে পূজা কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু বদ্রী তার হাত ধরে “তুই চল ভেতরে” বলে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাতে সে চিৎকার করে বলে উঠল, “প্রাণ দিয়ে দেবো আমি – তুমি শুনে যাও কাকী –”
বদ্রী তাকে আর একটু ভেতরের দিকে ধাক্কা দিয়ে টাল সামলে পা টেনে দরজার ঠিক পাশে রাখা জুতোজোড়াটা পরে বাইরে এসে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। সকালে স্নানের পর ধুতির ওপর ফতুয়াটা নিয়মমতো পরেই রেখেছিল সে। ভেতর থেকে পূজার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল, “ – ভালবাসি আমি দামুকে –” বদ্রী সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে হঠাৎ লাগা রোদ্দুরে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় টলমলে পা ফেলে রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আপন মনেই বলল, “পড়ে থাক তুই ভেতরে। তোর একটা ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে।”
বেবশ পূজার কান্নার আওয়াজ এখনও ভেসে আসছিল।
***
হরিরাম খাটের ওপর চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। নীচে মাদুরে বসে মুন্নি সঙ্গে রাখা কয়েকটা নুড়িপাথর নিয়ে খেলছিল। আর তার পাশে তার মা বসে আকাশকুসুম নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঢুলছিল। হঠাৎ দামুকে চৌকাঠের একটু ওপারে আসতে দেখে মুন্নি বলে উঠল, “দাদা এসেছে।”
হরিরাম চোখ খুলল। দামু তার দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুন্নির মা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে থামিয়ে যথেষ্ট নিচু গলায় বলল, “শোন তোর বাবার – আচ্ছা, তুই একটু বাইরে আয়।” বলেই সে নিজে বাইরে যেতেই দামু তার পেছন নিল।
“দ্যাখ দামু, তোর বাবার হঠাৎ কাশি উঠেছিল। সেই যে কি একটা হাওয়া দেওয়ার যন্ত্র সেটাও খালি হয়ে গেছে। আমি একটু আদারস আর নুন দিয়েছি। দেশী ওষুধ বিলেতি ওষুধের থেকে বেশি কাজ করে – জানিস তো। হ্যাঁ, দ্যাখ কেমন শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু ‘দিল’এর ‘বিমারী’ও আছে তো তাই তুই শীগগির ওষুধের ব্যবস্থা কর। তোর মাও তাই করতে গেছে। তুই ভেতরে যা। আমি একটু বাড়ি হয়ে আসছি।।” নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর অছিলায় অনর্থক উপদেশ মূলক কথা কটা বলেই মুন্নির মা তার বাড়ির দিকে রওনা দিলে পর দামু ভেতরে এসে মুন্নিকে যেতে বলে হরিরামের দিকে তাকাতেই সে তাকে কাছে ডাকল।
মুন্নি চলে যেতেই সে দামুকে বলল, “তুই আমার কাছে বস।”
“তুমি বিশ্রাম কর বাপু।”
“বিশ্রামতো এখন ওখানে গিয়েই হবে। চিরকালের বিশ্রাম।”
“অমনটা বলো না বাপু। তুমি শুয়ে থাক। আমি তোমার ওষুধের ব্যবস্থা করে আসি।”
হরিরাম ছেলের হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিল। “না, তুই বস। আমি এখন ভাল আছি। তোকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। মন দিয়ে শোন।”
দামু আর প্রতিবাদ করল না।
“তোর মনের মধ্যে যে আগুন জ্বলে তাকে শান্ত রাখ। ভগবানের নিয়মে গরীবদেরই হয়তো বেশি সহ্য করতে হয়। কিন্তু এই সহ্যের পরে সুখ নিশ্চয়ই আসবে। শান্ত থাকাটাই একটা বড় পরীক্ষা ওপরওয়ালার।”
অল্প একটু কেশে উঠতেই দামু বাধা দিতে চাইলে হরিরাম আবার বলে চলল, “আর বিদ্রোহ, বিপ্লব – এ সমস্ত এখন গরীবদের লাভ পাইয়ে দেওয়ার জন্যে নয়। এর ফল ধনীরা এবং ভ্রষ্ট নেতারা নিয়ে যায়। আমিও একদিন তোর মতো ছিলাম। কিন্তু দ্যাখ, এখন তো বিছানায় পড়ে আছি। তুই তোর মার কথা শোন। ও তোকে খুব ভালবাসে। ও চায় তুই কাজে যা – দু’পয়সা অর্জন কর। আর তাই দিয়ে কষ্টে ঘর চলুক। ভগবান চাইলে সব ভাল হবে। ওর কথাগুলো তেতো হলেও দ্যাখ আমাদের কথা কতো ভাবে। আমাদের জন্যে কতো কষ্ট করে। জানি না আমার ওষুধের জন্যে কোথায় কোথায় যে ছুটে বেড়াচ্ছে চড়া রোদ্দুর মাথায় নিয়ে।” থেমে গিয়ে দুচোখ বন্ধ করতেই তার কপালের দুদিকে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে গেল অশ্রুধারা।
দামু নিজেকে সামলাতে না পেরে ভেতরের ঘরে গিয়ে চোখ মুছল।
***
ট্রাক থেকে ধড় ধড় করে কয়লা পড়ল ইট ভাঁটার এক পাশের খালি জায়গাটাতে। বেলা একটু পড়ে এলেও রোদের তেজ কম হয়নি। কয়লায় কালো মুখ কয়েকটি মহিলা তাগারি মাথায় কয়লা বইছে। সন্ধ্যারও এবেলা তাই কাজ। অনতিদূরে ইটের থাকের ছায়ায় তিনটে ল্যাংটো বাচ্চা শুয়ে ঘু্মোচ্ছে। দূরে অন্য শ্রমিকরা নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। রাইমনি এই দূরের দিকটা দিয়েই ইট ভাঁটার সীমানায় ঢুকল। কয়েক মুহূর্ত চার দিকে দেখে দামুকে দেখতে না পেয়ে একটু এগোতেই মাটি তৈরি করছে এমন কাদামাখা এক পরিচিতা মহিলা তাকে অভিবাদন জানাল। “রাম রাম কাকী।”
“রাম রাম। দামুকে দেখছি না যে?”
“ও তো আজ কাজে আসেনি। কেন? কি হয়েছে কাকী?”
“না, কিছু নয়। সন্ধ্যা কোথায়?”
মহিলাটি কাদা হাত উঠিয়ে সন্ধ্যার অবস্থিতির দিকে ইশারা করে “ঐ ওখানে” বলে আবার নিজের কাজে লেগে গেল।
মাকে আসতে দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার কৌতূহলী প্রশ্ন, “কি হয়েছে মা?”
“কবে যে মাথাটা ঠিক হবে ছেলেটার? তোর বাবার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। ভাবলাম তাকে বলবো – তবে কিছু পয়সা যোগাড় করে ওষুধ নিয়ে আসবে। কিন্তু –”
“আমি তো ভাবলাম ভাই ঘরে আছে। এখন কি হবে মা?”
“তোর মালিককে বলে যদি কিছু টাকা পাস তাহলে –”
“মালিক? না মা, টাকার জন্যে বনবারী কাকা আর জুবেদ চাচা সকালে থাপ্পড় খেয়েছে। আমি গেলে আবার –”
“আমি সঙ্গে যাবো। অনুরোধ করবো। পায়ে ধরবো। তুই চল। মালিক নিশ্চয়ই শুনবে। ওষুধ না হলে যে কোন সময় অনর্থ ঘটতে পারে। তুই চল।” এক নিঃশ্বাসে মানসিক প্রস্তুতিটুকু কণ্ঠে প্রকাশ করেই রাইমনি নিজেই প্রথমে অফিস ঘরের দিকে পা চালাল। নিরুপায় সন্ধ্যা মার পেছন নিল।
রামদীন দূর থেকে ওদের যেতে দেখে কপাল কুঁচকালো। জুবেদ আর বনবারী বালি ওঠাচ্ছিল। রাইমনিকে দেখে চিনতে পেরে জুবেদ বলে ওঠে, “ও দামুর মা না?”
মাথা নেড়ে বনবারী বলে, “তাইতো। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে।”
***
রত্নাকর সিংহ খাতায় হিসেব শেষ করে নোট গুনে বাক্সতে রেখে বাক্সটা বন্ধ করতেই রাইমনি ভেতরে ঢুকল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই তার চোখে পড়ল রাইমনির অনুসরণে প্রবেশ করা সন্ধ্যার কয়লাতে কালো হয়ে যাওয়া সুন্দর মুখটা। চোখদুটো তার পলকহীন হয়ে বোবা মুখের সাথে মিলে হৃৎস্পন্দন বাড়াতে যাচ্ছিল কিন্তু ব্যাঘাত ঘটাল রাইমনির কণ্ঠস্বর।
“মালিক, আমি সন্ধ্যার মা।”
সামলে নিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রত্নাকর বলল, “অ্যাঁ, হ্যাঁ – বল।”
এবার রাইমনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই বল না।”
সকালের বাসনাটা আবার জেগে উঠতে গদ গদ হয়ে রত্নাকর বলে উঠল, “হ্যাঁ – হ্যাঁ, বল না। যা বলতে চাস খুলে বল আমায়।”
মেয়ের ইতস্তত বোধ লক্ষ্য করে রাইমনি নিজেই শুরু করল, “মালিক, সন্ধ্যার বাপুর শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। দীর্ঘ দিনের অসুস্থতা। এখন ওষুধও শেষ হয়ে গেছে।”
রত্নাকর তালু আর জিভ দিয়ে ‘চুক-চুক’ করে সহানুভূতির শব্দ বার করতেই রাইমনি যেন একটু সাহস জুটিয়ে মনের মধ্যে পূর্বেই তৈরি করে রাখা প্রার্থনাটা বলেই ফেলল, “এখন ওষুধের জন্যে কিছু টাকা দিয়ে দিন বাবু।”
রত্নাকরের সহানুভূতি দেখে মা’র কথার সমর্থন দিল সন্ধ্যা, “হ্যাঁ মালিক, আমরা দুই ভাই বোন আরও বেশি খাটবো।”
কামাসক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রত্নাকর যুক্তি দেখাল, “কোত্থেকে খাটবিরে ‘ভাইবোন’? তোর ভাই তো দুদিন হল কাজেই আসছে না।”
“আমি পাঠাবো তাকে। কাল থেকে ও আসবে। দিন না বাবু কিছু পয়সা।” রাইমনি দামুর জিম্মা নিল।
ধূর্ত রত্নাকর এবার শর্ত রাখল, “ঠিক আছে। পয়সা আমি দেবো। শুধু এইজন্যে যে এর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।” সন্ধ্যার দিকে ইশারা করে কথাটা বলাতে রাইমনি তাতে সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।
সদ্য বন্ধ করা পয়সার বাক্সটার দিকে বক্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে কুটিল হাসি হেসে পুরো শর্ত শোনাল রত্নাকর, “কিন্তু এখন তো টাকা নেই। সন্ধ্যের সময় কাজ বন্ধ হলে এসে নিয়ে যাস।”
“সন্ধ্যে তো প্রায় হয়েই এল মালিক।’’
রাইমনির এই আকুতিতে প্রথমে রেগে গিয়ে তারপর সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে পুনরায় ধূর্তামির হাসি হেসে অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে বোঝাল রত্নাকর, “আরে বললাম না! এখন টাকা যে নেই। বিল্টন নিয়ে আসবে। তুই কাজ শেষে এসে নিয়ে যাস। এখন যা – কাজ কর। আর শোন – এই টাকার কথা কাউকে বলিস না কিন্তু।”
রাইমনি অনিচ্ছাকৃত ভাবে মাথা নেড়ে শর্ত স্বীকার করে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে উদ্যমহীন গলায় বলল, “চল।”
***
রামদীন, জুবেদ আর বনবারী নিজের নিজের জায়গা থেকে রাইমনি আর সন্ধ্যাকে মাঝখানের সরু ইটের টুকরোর রাস্তাটা দিয়ে আসতে দেখল। কৌতূহল বশত জুবেদ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে রাইমনির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে বহিন?”
“এর বাপুর শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। তাই – ” রাইমনির ইচ্ছাকৃত ভাবে থমকে যাওয়াতে জুবেদই নিজের ধারণা দিয়ে তার কথাটা পুরো করতে চাইল, “তাই –তুমি পয়সা চাইলে আর মালিক ‘না’ করে দিল।”
সন্ধ্যার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, “ও বলল যে – ”
রাইমনি কথা ঘুরিয়ে দিল, “হ্যাঁ দাদা, মালিক তো না’ই বলে দিল।”
জুবেদ যেন বুঝেও বুঝল না। নিজের মনে মাথা নেড়ে অন্যদিকে চলল।
রাইমনি বড় রাস্তার ধারে এসে অত্যন্ত চিন্তিত ভাবে সন্ধ্যাকে বলল, “জানি না তোর মাথা খারাপ করা ভাই এখন কোথায় ঘুরছে আর তোর মালিকের জুয়াড়ি ব্যাটা টাকা নিয়ে আসবে কি না। কিন্তু তুই টাকা নিয়ে আসবি। নাহলে একটা কথা মনে রাখিস – তোর বাপুর যদি আবার কিছু হয় আজ, তাহলে আর তাকে বাঁচানো যাবে না।”