ধারাবাহিক উপন্যাস
দুপুর রোদে দামু আর পূজার অন্তরঙ্গতায় বাধা দেয় বিল্টন সিংহের দুই চেলা।
জমিয়ে দামু দু হাত করে নেয় ওদের সাথে। মার খেয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে পালায় দুজনে।
এদিকে, রামদীন সন্ধ্যার ওপর কুনজর দিয়ে তাকে বিরক্ত করে।
হরিরামের হাঁপানি হঠাৎ বেড়ে যায়। ওষুধ নেই। তাই রাইমনি টাকার জন্যে ইট ভাঁটাতে পয়সা চাইতে যায়। রত্নাকর সিংহ সন্ধ্যা কে বলে কাজের শেষে চুপিচুপি এসে পয়সা নিয়ে যেতে।
রাইমনি সন্ধ্যা কে বলে ওষুধ না পেলে তার বাবাকে আর বাঁচানো যাবে না।
এর পর –
পঞ্চম পর্ব
আমোদ, শোষণ আর দণ্ড
বলতে বলতে কেঁদে উঠে দ্রুত গতিতে প্রস্থান করল রাইমনি। কিছুক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে কাজে ফিরে এল সন্ধ্যা।
***
চতুর শিং এর আড্ডার বাইরের ঘরটাতে চলছিল বেআইনি জুয়ার আসর। পুলিস-টুলিসের ভয় এখানে ছিল না বললেই চলে। ন’মাসে ছ’মাসে ওপর মহলের তাগাদায় কখনো তাদের আগমন হলেও তার ব্যবস্থা আগে ভাগেই করা হয়ে যেত। বিল্টন সিংহ ছিল এখানকার জুয়া এবং মদ উভয় তরফের পাকা গ্রাহক –তাই সে ছিল ‘মাননীয়’। এখানে বলা বাহুল্য এই সর্ব কলা পূর্ণ ‘মাননীয়’ বিল্টন সিংহ মহোদয় ছিলেন মহামান্য রত্নাকর সিংহের একমাত্র পুত্র। ‘বিল্টন’ শব্দের কোন অর্থ হয় কিনা তার সংশয় সবার মনে থাকলেও ‘রত্নাকর’ শব্দের অর্থে সবাই ‘দস্যু রত্নাকর’ই বুঝত। বাপের নামের অর্থের এবং ক্রিয়াকলাপের প্রায় সমস্ত ছাপ বিল্টনের ওপর পড়লেও তার নিজস্ব কিছু মৌলিক বদগুণ অবশ্যই ছিল।
পর পর দুবার হেরে যাওয়ার পরও বিল্টন খেলছিল। তার মতে হারজিৎ কিছু নয়। খেলার উদ্যম থাকা দরকার। এবারে ব্লাইন্ড না খেলে তাস গুটিয়ে তুলে দুটো তাস এক এক করে দেখে তৃতীয়টা খুলতে যাবে এমন সময় কোথা থেকে ঢুকল তার দুই চ্যালা। তাদের দেখে বিল্টনের স্বগতোক্তি হল, “হুঁ, ‘লাক’ খুলবে এবার,” তারপর দুজনের উদ্দেশ্যে বলল, “কিন্তু কোথায় ছিলিরে এতক্ষণ তোরা? আরে! জগ্গা, তোর থোবড়া অমন হল কি করে? শালা, কোন মেয়ের পেছনে লেগেছিলি নাকিরে?”
জগদীশ উর্ফ জগ্গা যে দামুর হাতে মার খেয়ে এসেছিল গোমড়া মুখে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। সঙ্গের রসিক চরিত্রটি ছিল ছোটে লাল উর্ফ ছুট্কু। তিন গাঁ দূরে বাড়ি বটে তার, কিন্তু দিন রাত জগ্গার সাথেই থাকত সে। লোকে বলত তার নাকি জগ্গার সাথে কি একটা অন্য সম্পর্ক আছে তাই সে বেশির ভাগ রাতে বিল্টনের পয়সায় ভর পেট মদ গিলে জগ্গার সাথেই শোয়। বলিহারি এদের পরিবার!
ছুট্কু মুখ টিপে হেসে বলল, “তাই ধরে নাও ভাইজী।”
“চোপ বে। শালা ডরপোক! ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে এলি আমায় একলা ছেড়ে।”
আবার মনোযোগ সহকারে তৃতীয় তাসটির রহস্য উন্মোচন করতে করতে বিল্টন বলল, “হেঁয়ালি ছেড়ে খুলে বল।”
জগ্গাই বীরতা দেখাল এবার। “ঐ হারামি দামুর হিম্মৎ বেড়ে যাচ্ছে ভাইজী। সামনে এসে চোখ দেখাচ্ছিল। হয়ে গেল একহাত।”
ছুট্কু আবার ফিক করে হেসে ফেলতেই বিল্টন বুঝে নিয়ে বলল, “বুঝলাম – কয় হাত হল আর কিরকম। চিন্তা নট । কাল দেখে নেবো ওকে ভাঁটাতে সবার সামনে। ছাড় – মজা খারাপ করিস না। কাজে লেগে যা।”
শেষের কথাটা খেলাতে চৌর্যবৃত্তির অবলম্বনের উদ্দেশ্যেই ইশারা করে বলেছিল বিল্টন। কারণ যখনই ও জিতত চুরি করেই জিতত। চরিত্রের সাথে মিল খাওয়ানো ওটাই বোধহয় ওর ভাগ্য।
কথা না বাড়িয়ে দুই সাথীর সুবিধেমতো একটু দূরে দূরে বসে পড়াতে তিন তাসের বেআইনি জুয়া পুরো দমে চলতে লাগল।
***
সরু এক নিজেদের বানানো রাস্তার দু’ধারে তিরিশ চল্লিশ হাতের ব্যবধানে আঠারোটি ঘরের দলিত বস্তির অদূরে সদ্য সম্পূর্ণ এক কাঁচা পাকা দোতালা বাড়ির ছাদের ওপর টিভির অ্যানটিনা লাগানো হচ্ছিল। অ্যালুমিনিয়ম পাইপের স্টিক অ্যানটিনা। এলাকায় স্যাটেলাইট টিভি শুরু হবে হবে করেও হয়ে ওঠেনি। বাড়ির মালিকের বদলে নেওয়া নাম লাল শিং হলেও সে নাকি দলিত ছিল বলেই লোকে বলত। বছর খানিক আগে পর্যন্ত সে ইট ভাঁটাতেই কাজ করত আর বস্তির ঘরগুলোর মত ছোট একটা ঘর ছিল তার। হঠাৎ ধনবান হয়ে যাওয়ার পেছনে কোন সৎ কারণ ছিল এরকমটা অনেকেই মনে করত না।
ঐ বাড়ির একটু দূর দিয়েই বস্তির লোকেদের যাওয়া আসার সরু রাস্তাটা ধরে নানান চিন্তায় জর্জরিতা উদাস রাইমনি শ্লথ গতিতে চলতে চলতে নিজের কুটীরে প্রবেশ করতেই হরিরামের পাশে দামুকে দেখে তার সমস্ত চিন্তা যেন জট পাকিয়ে আগুণের ছোট ছোট গোলা হয়ে বেরিয়ে এল, “কিরে? ঘরটা এখন মনে পড়ল তোর? কোথায় ছিলিরে তুই? লজ্জা শরম কি নেই রে তোর? বাপ মরতে বসেছে – বুড়ো মা দোর দোর মাথা কুটে বেড়াচ্ছে – ”
“মা, তুই চুপ কর মা। বাপুর – ”
“কেন চুপ করবো শুনি? বড় বাপুর চিন্তা হচ্ছে! নিকম্মা হয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফিরলি। বললে ঝাল লেগে যায়?”
দামুর কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হরিরাম টিপ্পনী কাটল, “এসেই শুরু করলি?”
“হ্যাঁ – হ্যাঁ, তোমার তো মনেই হবে ‘শুরু করে দিলাম’।” বলেই দামুর দিকে কটাক্ষ করে বলল, “ ঐ দ্যাখ ওখানে – লাল শিংএর ঘরে টিভি এসেছে। কাল রেডিও পর্যন্ত ছিল না। কাজ করে তাই পয়সা পায়। উন্নতি করে – তোর মতো –”
হাত তুলে দামু প্রতিবাদ করল, “মা, তুই কেন হাত ধুয়ে আমার পেছনে পড়ে যাস?”
হরিরাম নিজের বাম হাত দিয়ে ছেলের হাত চেপে তাকে থামতে বলে। কিন্তু দামুর মুখ থেকে স্বপক্ষ সমর্থন সোচ্চার হল, “কি এমন অপরাধ করেছি আমি? শুধু দুটো দিনই কাজে যাইনি। গেলে কি তাজ মহল কিনে আনতাম নাকি? আরে সপ্তাহে মাত্র আড়াই শো টাকা আয় করার লোক জীবনে কি স্বপ্ন দেখবে? তাও যখন তিন সপ্তাহের পয়সা বাকী? একটাই ভাঁটা – কল কারখানা কিছুই নেই – রোজগারের কোন সুযোগই নেই। আর মা, তুই লাল শিংএর কথা বলছিস না? তাহলে শোন – যে কাজ লাল শিং করে সেই কাজ যদি সবাই করতে শুরু করে দেয় তাহলে টিভি কেন প্রত্যেক ঘরে বন্দুকও এসে যাবে। আর তখন প্রতিটা লোক এই ভয়ে দিন কাটাতে থাকবে যে কে কখন কার ওপর গুলি চালিয়ে দেবে। অত্যাচারের দুনিয়াতে সবাইকে থাকতে হবে তখন।”
থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাইমনি। মুখে তার বিব্রতবোধের ছাপ।
হরিরাম একটু কেশে বলল, “এবারে চুপ কর বাবা।”
“না , আমি চুপ ও হবো না আর এ গ্রামেও আর থাকবো না। অল্প স্বল্প যাইহোক পড়েছি। বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ মারা লোকেরাও শহর গিয়ে আমাদের থেকে চারগুণ আয় করছে। আমি কেন পড়ে আছি? মা’র জন্যে। এই গরিবিতে পিষে পিষে শেষ হয়ে গেলাম। বাপু, তোমার এই অবস্থা দেখে দেখে একা একা কাঁদি আমি।”
হরিরাম কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। তার বোধহয় হাঁপানিটা শুরু হচ্ছিল কিন্তু কারুর তা নজরে পড়ল না। রাইমনির দিকে তাকিয়ে বলে চলল সে, “এখন আর নয়। এখন আমি শহর চলে যাবো। কিছু করে দেখাবো। তাহলেই তোর কথায় কথায় টিপ্পনী কাটা বন্ধ হবে। তুই আমায় যেতে দে মা –ব্যস!”
চোখে জল এল দামুর। রাইমনির নজরে পড়ল স্বামীর খোলা মুখে নিঃশ্বাস আটকে যাওয়াটা। “কি হয়েছে?” বলেই তার বুকের ওপর নিজের হাত ঘষতে আরম্ভ করল। ঝাপসা চোখদুটো মুছে দামু তাড়াতাড়ি খালি পাম্পটা বাবার মুখে রেখে তিন-চার বার টিপতে টিপতে বলল, “নিঃশ্বাস নাও বাপু। দেখ আমি চুপ করে গেছি। আর কিছু বলবো না।”
রাইমনিও কথা দিল, “হ্যাঁ, আমিও আর কিছু বলবো না। তুমি শান্ত হও।”
হাঁপানির পাম্পটাতে থেকে যাওয়া অল্প ওষুধের কারণেই হোক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক কারণেই হোক হরিরাম এবার সামলে উঠল। দামু তাকে একটু জল খাওয়াল।
স্বামীকে ঠিক হতে দেখে শান্ত কণ্ঠে ছেলেকে বলল রাইমনি, “দামু, বিকেল গড়িয়ে এল। তুই ভাঁটাতে যা। মালিক সন্ধ্যাকে পয়সা দেবে বলেছে। তুই সন্ধ্যার থেকে পয়সা নিয়ে সোজা ওষুধের দোকান যা। ওষুধের বাক্সে ডাক্তারের কাগজটা আছে।”
মালিকের পয়সা দেওয়ার কথায় দামুর একটু সন্দেহ হলেও কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বাক্সটা থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাইমনি ছেলেকে যেতে দেখে স্বামীর প্রতি মনোযোগ দিল।
***
প্রথম দু ড্রিলে বেশ কিছু টাকা হেরে গেলেও দুই চ্যালা এসে ধোঁকাবাজি সহকারে যোগ দিতে বিল্টনের হেরে যাওয়া ধনরাশি দুগুণের বেশি হয়ে ফেরত এসে গিয়েছিল। আর সেই আনন্দে বিল্টন তাদের নিয়ে নাচ ঘরের কোনার টেবিলটা আগেভাগে দখল করে ইতিপূর্বেই বেশ নেশা চড়িয়ে ফেলে এখন নেশার ঘোরে এবং আবেগে নিজের মনের ভেতরের কালো ভাগটা আড়ম্বর সহিত প্রস্ফুটিত করছিল।
“দ্যাখ – শালা এই মদও কেমন অদ্ভুত জিনিষ! দু পেগ মারলেই সব রঙ্গিন হয়ে যায়। কতো রঙ্গিন স্বপ্ন মনে ভেসে ওঠে। ভোটে দাঁড়াবো। মদ খাইয়ে খাইয়ে ভোট নিয়ে জিতবো। গ্রামে গ্রামে মদের দোকান আর ‘বার’ খুলে দেবো। শালা, ঘরে ঘরে তখন মাতাল দেখতে পাবি। তারপর টাকা – রাস্তা বানানোর নামে ঠিকাদারদের দিয়ে দু-চার গাড়ি মাটি পাথর ফেলিয়ে বাকী টাকা পকেটে -বিদ্যুৎ আনার নামে টাকা – হাই ভোল্টেজ তার চুরি করিয়ে টাকা – শুধু টাকা – বুঝলি?”
জগ্গা যেন অনেক টাকা ভাগে পেয়ে গেছিল এমন ভাব দেখিয়ে একটানে অর্ধেক গ্লাস খালি করে দম্ভভরে মুখের ওপর হাত রগড়াতেই দামুর ঘুষির ব্যথাটা অনুভব হওয়াতে সে যে কথাটা বলতে যাচ্ছিল সেটা সে নিজের ভেতরেই দফন করে দিল।
ছুট্কু স্বভাব বশত কাঁধ সমেত মাথাটা ঝটকে দিয়ে নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্যে জিগ্যেস করে উঠল, “কিন্তু পাবলিক যদি জেনে যায় – তাহলে?”
“আরে, বুড়বক – শালা! পাবলিক কিচ্ছু জানতে পারবে না। আর যদি পারেও তাহলে কিচ্ছু বলবে না। আর যদি এক-দু জন বলতে আসেও তাহলে লাঠি-বন্দুক দেখালে চুপ হয়ে যাবে। আর যদি না হয় তাহলে – খালাস।” ডান হাতটা নিজের গলায় ঘষে ইশারায় ‘খালাস’ শব্দটার অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে নিজেকেই সমর্থন দিয়ে বিল্টন বলে উঠল, “দ্যাট ইজ রাইট।”
এবারে জগ্গার বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ শ্লেষ ব্যক্ত হল, “ভাইজী, আর কি কি যোজনা আছে – মানে – হবে?”
“হা – হা। ‘যোজনা’ – শালা ঠিক ধরেছিস। এর পরের যোজনা হবে বিয়ে – পূজার সাথে।”
বাইরের কাউন্টার থেকে এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “ ‘ব্যাগপাইপার’ হাফ দাও তো।”
বিল্টন হঠাৎ চুপ হয়ে গলার আওয়াজটা শুনেই টিপ্পনী কাটল, “এক হল ‘ব্যাগপাইপার’ আর আমরা হলাম চার। আওয়াজটা চেনা চেনা লাগছে।” ইশারাতে ছুট্কু’কে দেখতে বলাতে তার উঠে যাওয়ার পর পূর্বপ্রসঙ্গ ধরে বিল্টন বলল, “বিয়েটা পরে নয় – প্রথমে হবে – শালীর দেমাক আমি –”
ছুট্কু লড়খড়িয়ে ফিরে এসে নিজের চরিত্রের সাথে খাপ খাওয়ানো ভঙ্গীতে উত্তেজনা সহকারে বলে উঠল, “ভাইজী, অনেক লম্বা আয়ু আছে হবু বৌদির –”
হাতের গ্লাসটা দুম করে টেবিলের ওপর পটকে দিয়ে কৌতূহলে তাকিয়ে রইল বিল্টন।
ছুট্কু তার অসম্পূর্ণ উক্তি পূর্ণ করল, “ – তুমি নাম নিলে আর অমনি তার বাপ এসে গেল।”
জগ্গা ফিক করে হেসে ফেলতেই বিল্টন ধমক দিল, “আবে, চোপ। শালা, যার নাম নিলাম সে এল না আর তুই তার আয়ু – অ্যাঁ? কি বললি? তার বাপ এসেছে!” ছুট্কুর কথাটা একটু দেরীতে মাথাতে ঢুকতেই বিল্টন নড়বড়ে পায়ে বেরিয়ে গেল।
বাইরের কাউন্টারে যুবক সেলস্ম্যান দুশো টাকা চাইলে বদ্রীর খেয়াল হল টাকা সে আনতে পারেনি রাগের চোটে বেরিয়ে আসার জন্যে। অকপটে সত্য বলল বদ্রী, “টাকা যে আজ নেই।”
“তাহলে কাকা আজ খেও না।” চট করে বার করা বোতলটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বদ্রীর দিকে চেয়ে সত্য মিথ্যের যাচাই করার চেষ্টা করল যুবক।
“আমি যে রোজকার গ্রাহক।” মিথ্যে দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন বদ্রীর।
“টাকা ফেলেই মাল পাবে কাকা। এখানে সবাই রোজের গ্রাহক। মদ জিনিষটাই যে সেরকম।”
বিল্টন এতক্ষণে কাউন্টারে পৌঁছে যুবককে নিজের আধিপত্য দেখাল। “কি রে? আমার শ্বশুরজীর থেকে পয়সা চাস? বেশরম – নালায়েক –গবেট – দ্যাট ইজ কারেক্ট।” বিশেষণগুলো বলেই বোতলটা নিজে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে এবার বদ্রীর প্রতি সাফল্যের কুটিল হাসি হেসে আপ্যায়নের বুলি বলল, “আমি ধন্য হলাম যে আপনি এলেন, শ্বশুরজী! আসুন না ভেতরে।”
বদ্রীর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের সাথে ভেতরে যেতে যেতে বিল্টন উঁচু গলায় সহর্ষে বলে উঠল, “আরে পেগ লাগা রে শ্বশুরজীর জন্যে।”
যুবকটি নিজের কর্মজীবনে অনেক অদ্ভুত দেখা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বিল্টনের যাবার পথে তাকিয়ে থেকে আবার নিজকাজে মননিবেশ করল।
***
কাজ বন্ধ হয়ে গেলে পর ভাঁটার শ্রমিকেরা হাত-পা ধুয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছিল। অনেকে টাঙ্গিয়ে রাখা প্যান্ট জামা বদলাচ্ছিল। কেউ কেউ বা সুন্দর করে রাখা মাফলার গলায় জড়িয়ে মাথায় চিরুনি চালাতে চালাতে সমস্ত দুঃখ-দারিদ্র-ক্লান্তি ভুলে গুন গুন করে সদ্য প্রদর্শিত কোন সিনেমার গান গাইতে গাইতে এগোচ্ছিল।
সন্ধ্যা ধীরে ধীরে রত্নাকরের অফিস ঘরের দিকে চলতে আরম্ভ করেই ছিল এমন সময় দূর থেকে এক মহিলা বলে উঠল, “দিদি, বাড়ি যাবে না?”
“না, তুই যা। আমি পরে আসছি।” না থেমেই বলল সন্ধ্যা। তার মনে ছিল রত্নাকরের নির্দেশ।
অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করা রামদীন হঠাৎ সামনে এসে বলে ফেলল, “তুই কেন যাবি না এখন?”
“তোর তাতে কি?” থেমে গিয়ে জবাব দিল সন্ধ্যা।
“না, আমার কিছু না। সেই যে তোর মা এসেছিল – আর মালিকের কাছে গিয়েছিলি তোরা। তাই –”
“তাই – কি? তোর সব খবর দরকার? গোয়েন্দা নাকি তুই? এই স্বভাব ছেড়ে দে।”
দাঁত চিবিয়ে রামদীন টিপ্পনী করল, “একদিন তোর এই দেমাক কোথায় যে বেরিয়ে যাবে, বুঝবি তখন। আমি জানি তুই পয়সা নিতে যাচ্ছিস। ভালই তো – আজ তুই পয়সা পেলে কাল আমরা পাবো। হ্যাঁ হ্যাঁ, যা – তুই যা।”
অসভ্য রামদীনের জানা সত্যটাকে অস্বস্তির সাথে স্বীকার করে কথা না বাড়িয়ে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল সন্ধ্যা।
***
খাট থেকে মাথা নুইয়ে নুইয়ে মাটি থেকে এক হাত ওপরে আড়া-খাড়া ইট দিয়ে খোপের মত বানানো জানালা দিয়ে সন্ধ্যাকে আসতে দেখে ফিসফিসানির থেকে একটু উঁচু আওয়াজের সাথে কি একটা অশ্লীল বিদেশী ছবির এক বিশেষ লম্বা দৃশ্যের প্রথম ভাগেই ভিডিও প্লেয়ারটা চালিয়ে দিল রত্নাকর। তার মনে পড়ল প্রথমবার রামদীনের বউকে এই দৃশ্যের একটুখানি দেখাতেই বাকীটা প্রায় দৃশ্যের মতই নকল করে ফেলেছিল সে তাকে নিয়ে। তার সর্ব অঙ্গের মনোমত সঠিক ব্যবহার দ্বারা তাকে সম্পূর্ণ নিস্তেজ করে দিতে পেরেছিল বলে পরে নানান অছিলায় তিরিশ টাকা কেটে নিলেও সেই মুহূর্তের আবেগে পুরো পঞ্চাশটি টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়েছিল সে রামদীনের বউয়ের হাতে।
আজ সকালে সে সন্ধ্যার যে সমস্ত অঙ্গের দর্শন অভিলাষী ছিল সেই সমস্তের কল্পনা করা মাত্রই তার শরীরে অদম্য কামবাসনার উদ্রেক হল। ভেতরে এত কিছু হলেও বাইরে তার সংযম প্রদর্শন প্রশংসনীয় ছিল।
সন্ধ্যা প্রবেশ করে দেখল তার মালিক খাটের কোনাতে বসে টিভি দেখছে। মাত্র হাত দুই দূরে যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল না বটে তবে আওয়াজ শুনে সন্ধ্যার মনে ভাল কিছু ঠেকল না। সকাল সন্ধ্যে সাত্ত্বিকভাবে পূজো পাঠ করার সুফল তার শরীর ও মনের মধ্যে ঘর করেছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না।
রত্নাকর সন্ধ্যাকে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছে রেখেও তাকে না দেখার যেভাবে ভান করে ছিল সেই একই ভাবে রত্নাকরের থেকে বাঁচার জন্যে কিছু না শোনার ভান করে নতমস্তকে প্রার্থনা করল সন্ধ্যা। “মালিক টাকাটা দিয়ে দেন।”
রত্নাকরের ভ্রূক্ষেপ না হওয়াতে সন্ধ্যার পুনরায় ‘মালিক’ বলে ডাকাতে সে সাড়া দিল।
“উঁ – ও – তুই এসে গেছিস।”
“হ্যাঁ, মালিক। আপনি টাকা দেবেন বলেছিলেন।”
সন্ধ্যার কাতর প্রার্থনার বদলে কামাসক্ত শুকনো চতুর হাসি হেসে রত্নাকর কবিতা করে বলল, “হ্যাঁ, দেবো। কথা যে দিয়েছি তোমায় – রাখতে তা তো হবে আমায়। এদিকে আয় – এখানে – ছবিটা দ্যাখ – খুব ভালো। আয় না।”
জড়ানো গলায় আরও লজ্জার সাথে কোনদিকে না তাকিয়েই সন্ধ্যা করুণ ভাবে বলল, “টাকাটা দিন না মালিক। বাড়ি যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে।”
“ভালই তো। অন্ধকারে যাবি, কেউ দেখবে না। কাছে আয়। আমি তোকে পুরো মাইনে দেবো। আরও বেশি দেবো। তুই তোর বাপুর চিকিৎসা ভাল করে করাস। তোর ভাইয়ের মাইনেও বাড়িয়ে দেবো। শুধু একটিবার আয় –” বাসনার চরম সীমাতে পৌঁছানোর কারণে শেষের কথাগুলো বলতে রত্নাকরের জিভ আড়ষ্ট হয়ে এসেছিল। তাই আর কিছু বলতে না পেরে উবু হয়ে হাত বাড়িয়ে খপ্ করে সন্ধ্যার হাত ধরে ফেলল।
মুহূর্তের জন্যে সন্ধ্যার শরীর এবং মন সমস্ত বাধ্যবাধকতার উর্ধে চলে গেল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠল, “কি করছেন মালিক? আমি যে আপনার মেয়ের মতো। আপনি আমার বাপুর বয়সী।”
টাল সামলাতে রত্নাকরকে খাট থেকে হঠাৎ পা দুটো মাটিতে রাখতে হয়েছিল। কাম এবং ক্রোধ – দুই রিপুর মিশ্রনে চাপা আক্রোশ বেরুল তার মুখ থেকে, “মেয়েছেলে সোমত্ত হলে বয়সের তারতম্য দেখা উচিত নয়। শাস্ত্র বলে। বুঝলি? আর শোন – তোর বাপের কিছু হলে আমাকে দোষ দিবি না। শুধু নিজেকেই দোষ দিস।”
প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সন্ধ্যার নির্বাক মুখের ওপর গড়িয়ে পড়া চোখের জল দেখে রত্নাকরের ভেতর থেকে ক্রোধ রিপুটি সপাট বিদেয় নিল আর ‘কাম’ পুনরায় প্রবল হয়ে উঠল। নতুন করে সন্ধ্যাকে ছুঁয়ে তার হাত ধরে “সব ভুলে যা, একটিবার আয়।” বলে তাকে নিজের দিকে টানতে থাকল।
সুদূরে অস্তমিত সূর্যের হারিয়ে যাওয়া উত্তাপের মতো এইক্ষনে সন্ধ্যার হারিয়ে যাওয়া মনোবলের সাথে তার শরীরটা শ্লথ হয়ে এল। টিভির ফিসফিসানি আওয়াজ, রত্নাকরের কামাসক্ত আড়ষ্ট কণ্ঠস্বর, বাইরে পাখীদের বাসায় ফেরার কলরব – সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়ে লাচার রাইমনির করুণ কণ্ঠস্বরে রূপান্তরিত হয়ে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে সন্ধ্যার কান দিয়ে মস্তিষ্কে আর তা থেকে হৃদয়ে গিয়ে কেমন যেন এক অব্যক্ত ব্যথার উদ্রেক করতে লাগল।
“ … তোর বাপুর যদি আবার কিছু হয় আজ, তাহলে আর তাকে বাঁচানো যাবে না।”
***
ভগ্ন মনে চলতে চলতে সূর্যদেবকে তরতর করে দিগন্তের আড়াল হয়ে যেতে দেখে নিজের চলার গতি বাড়িয়ে দিল দামু। দেখতে পেল সামনের দিক থেকে আসা শ্রমিকের এক দলকে। তাদের এক এক করে পার করতে দেখা হল পিছিয়ে পড়া জুবেদ আর বনবারীর সাথে। আশ্চর্য চকিত জুবেদ প্রশ্ন করে অসময়ে আসার কারণ জানতে চাইলে সমান বেগে চলতে চলতে অকপটে বলল দামু, “চাচা, বাপুর শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। আমি ওষুধের জন্যে টাকা আনতে যাচ্ছি।”
ইতিপূর্বে পেরিয়ে আসা রামদীন হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে টিপ্পনী কাটল, “হ্যাঁ – হ্যাঁ, তুই তো টাকা পেয়েই যাবি। যা, দ্যাখ গে যা অন্ধকারে তোর দিদির সাথে হিসেব কিতেব কতটা এগোল।”
ঝড়ের দমকা হাওয়ায় নুইয়ে যাওয়া গাছের হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে পড়ার মতোই ভগ্ন মনের দামু সবেগে ছুটে এসে আক্রমণ করল রামদীনকে।
রামদীনও হুংকার মেরে অগ্রসর হয়েছিল বটে কিন্তু সবাই মিলে দুজনকে ছাড়িয়ে দেবার আগেই দামুর হাত থেকে কয়েকটি লাথ ঘুষি সে খেয়ে ফেলেছিল। বেশ চীৎকার চেঁচামেচির পর দামুকে শান্ত করিয়ে জুবেদ বলল, “টাকার প্রয়োজন আমাদেরও যথেষ্ট ছিল বাবা। কিন্তু সে লোক তো মজদুরির বদলে গালে থাপ্পড় কষেছিল। তুই যা, সন্ধ্যা ‘বিটিয়া’কে দ্যাখ।”
কাল বিলম্ব না করেই নানান অশুভের অদম্য কল্পনার সাথে ইট ভাঁটার দিকে ছুটতে লাগল দামু।
***
পাঞ্জাবীটা পরে নিয়ে বাক্স খুলে সব টাকা বের করে তার থেকে তিনটে একশো টাকার নোট অবিন্যস্ত চুল আর অগোছালো শাড়ির সাথে প্রাণহীন মূর্তির মত স্থিরদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা সন্ধ্যার হাতে রেখে রত্নাকর বলল, “এই নে,” আর পর মুহূর্তে পলকহীন সন্ধ্যার মুঠো বন্ধ করার আগেই ডান হাত দিয়ে চট করে একটা নোট তুলে নিয়ে বাম হাতের নোটগুলোর থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট তার হাতে রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে যেন কিছু বেশি দিচ্ছে এমনভাবে পুনরায় বলল, “হ্যাঁ, এইটাও নে। রেখে নে। এখন যা। আর যখনই টাকার দরকার হবে কাজের শেষে এমনি করে চলে আসিস। তুই আমার মন ভুলিয়ে দিয়েছিস রে!” বলেই বাকী টাকাগুলো পকেটে রাখতে রাখতে আত্মতুষ্টিতে নাকিসুরে হেসে উঠল রত্নাকর তার সবকটা দাঁত বার করে।
শেষের কথাগুলো নিজেরই পাওনা টাকার একতৃতীয়াংশ – মাত্র আড়াই শো টাকার বিনিময়ে সবকিছু হারিয়ে ফেলা সন্ধ্যার কানে স্পষ্ট হল না বটে কিন্তু রত্নাকরের হাসিটা গোধূলির আলোআঁধারিতে দূরের বড় গাছগুলোর নিচের ঝোপঝাড় থেকে কাল্পনিক এক হায়নার রূপ ধরে বেরিয়ে আসা কোন নিষ্ঠুর দৈত্যের অট্টহাসি বলে তার মনে হল।
***
ইট ভাঁটার মুখের রাস্তাটায় পৌঁছুতেই আলুথালু বেশে হাতের মুঠোয় টাকা নিয়ে চলে আসা সন্ধ্যার মুখোমুখি হল দামু। তার হাতের টাকা এবং গাল বয়ে যাওয়া চোখের জল বোধহয় গোধূলি বিদায়ে ঘনায়মান রাত্রির অন্ধকারে দামুর দৃষ্টিগোচর হল না কিন্তু তার অতি আদরের বড় দিদির সাথে সদ্যঘটিত চরম অশুভের স্পষ্ট ইঙ্গিত সে পেয়ে গেল। নির্বাক সন্ধ্যা ভাইকে এক নজর দেখেই নিজের পথে এগিয়ে চলল। দামুর মনের ভেতর সদ্য জাগরিত ভয়ংকর ক্রোধ তাকে কোনপ্রকার বার্তালাপের সুযোগ না দিয়ে রত্নাকরের অফিস ঘরের দিকে ধাক্কা দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে সন্ধ্যা ভাইকে থামাতে চাইলেও তার মনের ভেতর সদ্যোজাত অব্যক্ত ইচ্ছেটা তাকে তা করতে দিল না। তার ছিন্ন হৃদয়ের গভীর হতে যেন এক নিঃশব্দ হাহুতাস বেরিয়ে এল, “সর্বনাশ হোক শয়তানটার।”
***
বাক্সটায় তালা লাগিয়ে চাবিটা পকেটে রেখে ধুতি ঠিক করছিল রত্নাকর। দ্রুত এবং ভারী পায়ের শব্দে মাথা তুলে তাকাতেই চিনতে পারল সে দামুকে। গোধূলির সমাপ্তিতে রত্নাকর রুপী এই রাক্ষসটার নৃসিংহ অবতারের কথা হয়তো মনে পড়ল না কিন্তু সাক্ষাৎ যমকে যে সে দেখতে পেল এবিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না। কোন ভণিতার আশ্রয় না নিয়েই যত দ্রুত সম্ভব সে বলে উঠল, “আমি তোর পুরো পরিবারের জিম্মাদারি নেবো, – ”
আর কিছু বলতে পারার আগেই রত্নাকরকে তুলে আছড়ে দিয়ে লাথি মেরে তাকে এদিক ওদিক গড়াতে গড়াতে দামু তারই কথার জবাবে বলে চলল, “আর বাকী সব পরিবারের ওপর জুলুম করবি। কাউকে দিনে থাপ্পড় মারবি –”
“আমার কথা শোন – ”
“আর কাউকে একলা ডেকে রাতের অন্ধকারে টাকা দিবি তার জীবন শেষ করে,তাই না?”
“আমায় ছেড়ে দে – ছেড়ে দে রে – আমার মস্ত বড় ভুল – ” কথাটা শেষ করতে পারল না রত্নাকর। শুধু গোঙাতে লাগল। লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে তার টিভিটার ওপর পড়াতেই সেটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
ক্রোধান্মত্ত দামু এবার তার গলা টিপে বলে যাচ্ছিল, “আর কখনো ভুল করবি না। কক্ষনো না। তোর মতো হারামিকে চৌরাস্তার মাঝখানে রেখে মেরে ফেলা উচিত। তোর বাঁচার কোন অধিকার নেই।” হাঁপাতে হাঁপাতে ক্রোধে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে গুরুতর আহত রত্নাকরের গলায় নিজের হাতের চাপ বাড়িয়ে চলল দামু। কিন্তু ইতিপূর্বেই মৃত রত্নাকরের কোন প্রতিক্রিয়া অনুভব না করাতে চরম দুঃখ, ক্রোধ এবং বিস্ময়ের সাথে হাতের চাপ ছেড়ে দিতেই রত্নাকরের শিথিল নির্জীব শরীরটা তার পায়ের নীচে ঘষড়ে পড়ল।
সম্বিৎ ফিরে আসা দামুর চোখের সামনে তার হাঁপানিগ্রস্ত পিতা, লাচার মা এবং সর্বশেষে ধর্ষিতা দিদির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠতেই তার চোখ ধোঁয়াশা হয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এই মুহূর্তে সঠিক তার কি করা উচিত ভেবে না পেয়ে পাপে ভরা চরম অস্বস্তিকর অফিস ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে পেছনের রাস্তাটা দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
***
অনেকবারের মত আজও কাজ শেষ হওয়ার অনেক আগে রত্নাকর অছিলা করে দুটো কাজের ভার দিয়ে মুনিমকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল যাতে সে রাত্রির আগে ফিরে আসতে না পারে। এই মুহূর্তে ফিরে এসে ভাঁটার সামনে দিয়ে ঢুকতেই মুনিমের মনে হল কেউ যেন পেছনের রাস্তাটা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
“কে রে ওখানে? কে যাচ্ছিস রে?” আন্দাজে প্রশ্ন সে ছুঁড়ল বটে কিন্তু জবাব কিছু এল না। শুধু ভেসে এল ভিন গাঁ থেকে আসা একমাত্র আবাসিক শ্রমিক দেবনারায়ন উরফ দেবুর রেডিওর গানের আওয়াজটুকু।
সন্দেহ বশত মুনিম এসে ঢুকল হাট করে খোলা অফিস ঘরটাতে। অশুভ কিছু ঠাওরে পকেটে রাখা দেশলাই থেকে হাতড়ে একটা কাঠি বার করে জ্বালাতেই তার মুখ থেকে প্রলাপের মত অস্পষ্ট স্বর বেরিয়ে এল, “এ –এ, আরে দ্যাখ রে – মালিককে দ্যাখ রে –” জ্বলন্ত দেশলাই কাঠিটা হাতে ছ্যাকা লাগিয়ে দিতেই এক দৌড়ে বেরিয়ে এসে অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে দুপায়ে দুহাতে বাঁদরের মত চলে এসে দেবুর ছোট ঘরটার বাইরে মাত্র হাত তিনেক চওড়া বারান্দাটায় ধপাস করে বসে পড়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, “আরে ও দ্যাবা – হারিকেনটা নিয়ে শীগগির আয়।”
রেডিওটা বন্ধ না করেই হারিকেন হাতে দেবু এসে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”
“চুপ, চীৎকার করবি না। চল, অফিসঘরে।” একটু সামলে নিয়ে বলল মুনিম।
***
তড়িঘড়ি করে অফিসঘরের ভেতরে এসে দেবুর গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল। হারিকেনটার সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন এবং পরামর্শ দুটোই সামনে রাখল। “এখন কি হবে? মালিকের বাড়িতে খবর দেওয়া উচিত।”
বুড়ো মুনিম জীবনে অনেক কিছু দেখেছে শুনেছে। বাঁহাতের মুঠোয় রাখা দেশলাইটা পকেটে রেখে চাপা গলায় মাথা নেড়ে বলে উঠল, “না, এটা খুনের মামলা। পুলিস আসবে। দশ কথা হবে। আমরা দুজনেই ফেঁসে যাবো। না, আমি বরং বিল্টনকে ফোন করি।” বলেই চোখদুটো কুঁচকে কিছু চিন্তা করে আবার বলে উঠল, “আমি কাউকে যেন পালাতে দেখেছিলাম। তুই দেখেছিস কাউকে?”
“হ্যাঁ, আমি দেখেছিলাম – সন্ধ্যা যাচ্ছিল আর – ”
“আরে বল না শালা – আর কি?”
“আজ্ঞে, দামু – হ্যাঁ, দামু আসছিল আর – ”
“দামু! দামু করল এইরকম! শুয়োর, তুই পেছন নিলি না কেন?”
“আজ্ঞে, ও অফিস ঘরের দিকে গেল। আর আপনি তো জানেন মালিক পছন্দ করত না আসাযাওয়া লোকের খবর কেউ রাখে। প্রায়ই সন্ধ্যের সময় তো – ”
গোপনীয়তা যা দেবু জানত রত্নাকরের ব্যাপারে তা প্রকাশ করতে চাইতেই ভাগীদার মুনিম তাকে থামিয়ে দিল। “আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন মুখ বন্ধ রাখ।” বলেই পকেট থেকে রত্নাকরেরই দেওয়া মোবাইল ফোনটা বার করে বিল্টনের নাম খুঁজে ‘কল’ বোতামটা টিপল।
***
মদে টইটম্বুর বিল্টন বদ্রীকেও গলা পর্যন্ত নেশা করিয়েছিল। প্রথমবার নাচ দেখার জন্যে উদগ্রীব বদ্রীর আকর্ষণ বাড়াচ্ছিল বিল্টন। “আজ শীলা বাঈ নাচবে গো, শ্বশুরজী। ‘দিল’ খুশ হয়ে যাবে।” আর কিছু বলার আগেই মিউজিক শুরু হয়ে গেল। অধীর আগ্রহে শীলা বাঈয়ের প্রবেশ দ্বারের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই এমন সময় বিল্টনের পকেটের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল।
“আবে, কে রে শালা, মজা খারাপ করছিস?” মাতলামির সাথে টেনে টেনে বলতে বলতে প্রবেশ রত শীলা বাঈয়ের ওপর থেকে চোখ না তুলেই হাতড়ে হাতড়ে পকেটের ভেতরেই ফোনটা কেটে দিল বিল্টন। তারপর হাতটা বার করে নিজের মুখের চুমু নিয়ে খ্যামটা নাচের নিম্নমানের ঘাঘরা-চোলী পরা কিঞ্চিত সুন্দরী নর্তকীর দিকে ছুঁড়ে দিতেই ফোনটা আবার বেজে উঠল।
“কে রে বুড়বক? তোর বাড়িতে এইরকম ‘ছামিয়া’ আছে নাকি যে আমি তোর ফোন শুনবো? শালা!” হিন্দি সিনেমার ‘আইটেম’ গানের উঁচু আওয়াজ, নর্তকীর নগ্ন নাভিস্থল এবং অর্ধ নগ্ন বক্ষস্থল প্রদর্শন আর মিউজিকের তালে লাগানো তার ঠুমকার মিশ্র প্রভাব বিল্টনকে এমন বিভোর করে দিল যে নেশার ঘোরে অস্পষ্ট ভাবে কথা কটি আওড়ে ফোনের স্ক্রিনে নাম দেখার প্রবণতা না রেখেই ফোনটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে বাম হাতে টেবিল থেকে মদের গ্লাসটা তুলে নিয়ে গানের তালে নাচতে লাগল সে। নির্লজ্জ বদ্রী এহেন জামাই বোধহয় আর পাবে না এমন ভাব দেখিয়ে একবার বিল্টনের দিকে প্রশংসা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরক্ষনে নর্তকীর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হাতের গ্লাস হাতে রেখে চ্যালা দুটি অন্য অনেকের সাথে উঠে দাঁড়িয়ে সিটি বাজিয়ে নাচতে শুরু করে দিল।
***
দেবুর প্রশ্নবোধক দৃষ্টির জবাবে ফোনটা পকেটস্থ করতে করতে মুনিম বলল, “প্রথমে কেটে দিল আর এখন ফোনই বন্ধ করে দিয়েছে বোধহয়। ও এখন কোথায় থাকবে তা আমি জানি। তুই এখানে তালা লাগিয়ে, চাবিটা আমায় দে। আর ঘরে গিয়ে মুখ বন্ধ করে থাক।” পর মুহূর্তেই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বলল, “না, তুইও আমার সাথে চল। হারিকেনটা তোর ঘরে রাখ। আমরা টর্চ নিয়ে যাবো। চল, তাড়াতাড়ি কর।”
মুনিম বেরিয়ে আসতে দেবু কোণা থেকে তালা চাবি তুলে দরজায় তালা দিয়ে চাবি মুনিমের হাতে দিয়ে নিজের ঘরে হারিকেনটা রেখে রেডিওটা বন্ধ করে রত্নাকরের দেওয়া তিন ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে এসে মুনিমের সঙ্গ ধরল।
***
অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এসে নিজের ঘরের দোরগোড়ায় পা আটকাল যেন সন্ধ্যার। হাতে গোঁজা নোট কটা নিয়ে নির্বাক নিশ্চল দাঁড়িয়ে গৃহদেবতার কাছে ক্ষমা যাচনা করে প্রবেশের অনুমতি পেতে চাইছিল যেন। চিমনির ওপর দিক কালো হওয়া হারিকেনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে বাতি তুলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে সব বুঝতে পেরে মেয়েকে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করল রাইমনি। “এ কি হল রে! হে ভগবান! এটাই কি বাকী ছিল? আর আমরা কি করে মুখ দেখাবোরে লোকের সামনে? একবারও কি ভাবলি না? হে ভগবান!” হারিকেন মাটিতে রেখে দুহাতে মাথা চাপড়ে রাইমনির পরিতাপ কানে গেল অশান্ত হরিরামের আর তার চোখে আবছা হয়ে এল হাতের মুঠোয় ধরা নোটগুলোর সাথে সন্ধ্যার পুরো অবয়বটা। বিস্ময়, দ্বিধা, ঘৃণা, লজ্জা এবং ভয়ের মুহুর্মুহু মিশ্র অভিব্যক্তির সাথে চীৎকার করে যেন সে বলে উঠতে চাইল, “সন্ধ্যা, আর কোন পাপের সাজা দিলিরে আমায় পোড়ারমুখী?”
কিন্তু শুধু সন্ধ্যার নামটুকু উচ্চারণ করার পরই তার গলায় হৃদয়ের গভীর থেকে উত্থিত চরম দুঃখের বাষ্প আটকা পড়ল। বুকের মধ্যে এক অসহ্য প্রবল যন্ত্রণার সাথে চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসতে চাইল। হারিকেনের টিম টিম আলোটাই যেন অন্ধকারের স্রোত হয়ে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল। নিমেষে রাইমনির মনে হল বাম হাত দিয়ে বিছানার চাদরটা মুচড়ে ধরে রাখা প্রচণ্ড ব্যথায় বিকৃত- মুখ হরিরামের দীর্ঘ কালের পঙ্গু হওয়া ডান হাতটা যেন একটু নড়ে উঠল। পর ক্ষণে রাইমনির কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমস্ত ব্যথা বেদনার অবসান ঘটিয়ে হরিরামের শরীরটা নিশ্চল হয়ে গেল।
মনের আওয়াজে বুঝে নিয়ে স্বামীকে নাড়া দিতে দিতে চাপা কণ্ঠে হাহাকার করে অনুপস্থিত একমাত্র সম্বল পুত্রের নাম ধরে বিলাপ করে উঠল রাইমনি, “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল রে দামু। দ্যাখ তোর বাপু আমাদের ছেড়ে চলে গেল রে।”
গাল গড়িয়ে পড়া চোখের জল নিয়ে বাবার পায়ে মাথা কুটে কুটে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগল নিষ্ফল বলিদান দেওয়া সন্ধ্যা।
***
অন্ধকার পথে দিশেহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে দামু সোজা এসে থামল নিস্তব্ধ পুকুর পাড়ের বট গাছটার নীচে। জীবনে কত সমস্যার সমাধান সে এখানেই পেয়েছিল। কত শত বার তার অশান্ত মন এখানেই শান্ত হয়েছিল। কিন্তু আজ? আজ কেন তার মনের মধ্যেকার আলোড়ন শান্ত হল না? এরকমটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ক্রোধ, দুঃখ আর অপরাধ বোধের মিশ্র এক অচিন অনুভূতির সাথে বুকফাটা কান্না কেঁদে উঠল সে।
***
মাঠের অপর প্রান্তে ছোট শহর বা কসবা যাবার সোজা রাস্তাটা দিয়ে টর্চ নিয়ে হেঁটে চলেছিল মুনিম। পেছনে ছিল দেবু। মনে তার নানান চিন্তা – নানান ভয় সংযুক্তভাবে অনেক প্রশ্ন এবং তাদের একাধিক যৌক্তিক অযৌক্তিক সমাধান দাঁড় করাচ্ছিল। অতি স্বল্প বিরামের সাথে মুনিম রত্নাকর এবং বিল্টনের চারিত্রিক দোষ-গুণ, তার নিজের সততা, অতীতের ঘটনাবলী এবং নিকট ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ব্যাপারে অসংলগ্ন বিষদ ব্যাখ্যান দিচ্ছিল বটে কিন্তু তাতে দেবুর সংশয় উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছিল। জুবেদের পাড়ার মোড়টা পেরিয়ে স্বল্প বিরামের ফাঁকেই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে মুনিম বলে উঠল, “ইস্কুল মোড়ে রিকসা থাকলে একটু তাড়াতাড়ি হবে।।”
একটু ক্ষণ আগে পর্যন্ত ছোট ছোট ‘হ্যাঁ’ ‘হুঁ’ দেওয়া দেবুর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পেছন ফিরে মুনিম দেখল দেবুর অস্তিত্ব নেই। ঘন অন্ধকারের মধ্যে বুক ছ্যাঁতকে উঠল তার। হিম্মৎ জুটিয়ে এদিক ওদিক টর্চ মেরে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “এ দ্যাবা, কোথায় গেলিরে শালা?” পূর্ববৎ কোন উত্তর না পেয়ে দেবুকে খোঁজার চেয়ে বিল্টনের কাছে পৌঁছান অনেক বেশি জরুরী ভেবে টিপ্পনী করে এগিয়ে চলল মুনিম। “শালা, ভয়ে তাড়ি খেতে পালিয়ে গেল বোধহয়।”
***
তাড়ি যে দেবু খেত তা মিথ্যে ছিল না। নপুংসকতার খেতাব দিয়ে যার বউ পালিয়েছিল আর নিজের মান বাঁচাতে যে গাঁ ছাড়া হয়েছিল তার পক্ষে একটু তাড়ি-ভাং তো ন্যায্য বলেই গণ্য হত। কিন্তু এইরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তার মাথায় তাড়ির কথা একেবারেই স্থান পেয়েছিল না। একটু একটু পিছিয়ে থাকতে থাকতে জুবেদের পাড়ার মোড়টা আসতেই চুপ করে বাঁ দিকে কেটে পড়ে মুনিমের কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে অন্ধকারে যতটা সম্ভব দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তার একটু ভেতরে ছিটে বেড়ার ঘরে গুপ্ত তাড়ির আড্ডা পর্যন্ত পৌঁছে গেছিল সে। কে একজন হঠাৎ টলতে টলতে বেরিয়ে এসে দেবুর গায়ে গা ঠেকাল। প্রায় তার মুখের ওপর চোখ রেখে মুখ থেকে তাড়ি, বিড়ি ও খইনির মিশ্র দুর্গন্ধ ছেড়ে লোকটা সজোরে বলে উঠল, “কে গো? দেবনারায়ন নাকি?”
দেবুর গেল পিলে চমকে। মুনিম বোধহয় এখনও বেশি দূর গিয়েছিল না। কোন জবাব না দিয়েই কাটল সে। মাতালটা ঠাওরে নিয়ে বিপরীত দিকে নিজের রাস্তা ধরে নিজ মনেই বলল, “না? কিন্তু দেবনারায়নই তো মনে হল যে। ধেৎ শালা বুড়বক! তাড়ির ভাই দম আছে রে!”
এবার সোজা বিনা বাধায় দেবু পৌঁছুল জুবেদের বাড়ি।
***
ধর্মভীরু মুসলমান বিপত্নীক জুবেদ আলি খান। প্রায় আটত্রিশ বছর আগে বিশ বছরের যুবক জুবেদ দূর সম্পর্কের এক মাসীর মেয়ের সাথে ভালবাসা করে নিকা করেছিল। পর পর দুটো ছেলে হয়ে মারা যাওয়ার পর একটা মেয়ে হয়েছিল তার। বিভিন্ন কাজী-ফকীরের কাছে গিয়ে বুঝেছিল তার নাকি পুত্রসুখ নেই। বউ মত দিলেও তাকে সে এত ভালবাসত যে সে আর বিয়ে করল না। মেয়েটা তাদের ছিল সন্ধ্যার বয়সী এবং তার বান্ধবীও। আসলে সরকারের দলিত বস্তি বানিয়ে দেওয়ার আগে এই গাঁয়েই থাকত হরিরাম এবং জুবেদের সাথে ছিল তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। বিয়ের পর রাইমনির সাথে জুবেদ বোন পাতিয়েছিল বটে কিন্তু সন্ধ্যা ছোটবেলা থেকে তাকে চাচা বলেই ডাকত এবং তা’ই সবার স্বীকার্য হয়েছিল। দামুও পরে সেই সম্বোধনই করা শুরু করেছিল। দু’- দু’বার তালাক হওয়ার পর পাঁচ বছর আগে নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে ভিন গাঁয়ের এক প্রৌঢ়ের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল জুবেদের আদুরে মেয়ে রাবেয়া। তার এক বছর পর জুবেদের বউ মারা গিয়েছিল গ্যাস্ট্রিক আলসার আর জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে। স্ত্রীর বিরহে যৌবনে অত্যন্ত হাস্যরস প্রিয় সবল জুবেদ কেমন যেন হঠাৎ বুড়িয়ে গেল। তিন বছর আগে একটা চিঠি এসেছিল রাবেয়ার কুশল সমাচার নিয়ে। নবাবদের শহর লখনউ-এর শহরতলিতে ছিল সে তার পরিবারকে নিয়ে। মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পেরেছিল। একটা ছেলেও হয়েছিল। ঠিকানা যা দেওয়া ছিল তাতে জুবেদ কয়েকখানা চিঠি বছর খানেকের মধ্যে লিখে কোন জবাব না পেয়ে লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন সে ছিল সম্পূর্ণ একা। শুধু ইট ভাঁটা আর বাড়ি।
রোজকারের মত খাবার খেয়ে হারিকেনের বাতি কমিয়ে রেডিওতে গান শুনছিল জুবেদ যখন ভয়ার্ত দেবু চুপি চুপি ঢুকল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ভরা পেটে গান শুনতে শুনতে চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল বলে দেবুর টের পেল না সে। দেবু রেডিওটা বন্ধ করে দিতেই ধীরে ধীরে চোখ খুলে তার দেবুকে দেখে বিস্মিত হয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই চাপা গলায় কোনরূপ ভণিতা ছাড়াই সমস্ত কথা শুনিয়ে দেবু বলল, “সন্ধ্যার ওপর অত্যাচার হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। দামুকে আমি ভাল মনে করি আর তুমিও তাকে নিজের ছেলের মত দেখ। তাই এই খবরটা আমি তোমায় দিয়ে চলে যাচ্ছি।”
“কিন্তু যাচ্ছ কোথায়?”
“জানি না। কিন্তু এ ঝামেলায় আমি জড়াতে চাই না, চাচা। চলি আমি।” বলেই বারান্দা থেকে নেমে একটু ভেবে নিজ গাঁ আর যৌথ পরিবারের মায়া কাটিয়ে স্কুল মোড় থেকে মাঠের মধ্য দিয়ে স্টেশনের শটকাট রাস্তাটা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরত পথে পা চালাল শঙ্কাকুল দেবু।
***
স্কুল মোড়ে যথারীতি রিকশা না পেয়ে পায়ে হেঁটেই মুনিম পৌঁছুল চতুর শিংএর আড্ডায়। নাচ গান এখনও চলছিল।
প্রতিটা গানের শেষের দিকটায় কিছু কিছু মাতাল সুযোগ করে স্টেজে এসে নেচে নোট ওড়াত বোম্বাইয়ের স্টাইলে। পার্থক্য ছিল শুধু নোটের মূল্য এবং পরিমাণ। ওখানে হয় একশো, পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট – যথেষ্ট। আর এখানে হত দশ-কুড়ি টাকার নোট – স্বল্প। তাই থেকেই বাঈজীদের ভাল কমিশন হয়ে যেত। নাচের ছলে বিভিন্ন ভঙ্গীতে বাঈজী নোট গুছিয়ে নিয়ে ভাড়া করা পোশাক আর চুলের স্টাইল বদলে বিরতির পর আবার শুরু করত নাচ। বিশেষ কোন কোন দিনে ভাড়া করা বিশেষ বাঈজীর সংখ্যা দুইও হয়ে যেত আর সেদিনগুলোতে পঞ্চাশ-একশো টাকার দু চারটে নোটও দেখা যেত।
কিন্তু আজ কোন বিশেষ দিন ছিল না। তাই বিল্টন গোটা কয়েক কুড়ি টাকার নোট নিয়ে নেশার টাল সামলে এক এক করে নোট ঘুরিয়ে ছুঁড়তে ছুঁড়তে নর্তকীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছিল। দূরে কোণার টেবিলটাতে বসে নেশায় চূর বদ্রী লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এরকম সুযোগ না পাওয়ার জন্যে নিজের আর্থিক অবস্থাকেই মনে মনে দোষারোপ করছিল। জগ্গা এবং ছুট্কুরও প্রায় তাই অবস্থা কিন্তু তারা নিজস্থানে বসেই অন্য অনেকের মত গানের তালে নেশাড়ে শরীর নাড়িয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমার প্রদর্শন করছিল। নর্তকীর ভেতরে যেতেই বাকিদের সাথে বিল্টনও নীচে নামল। অন্য একটা গান অপেক্ষাকৃত নিচু আওয়াজে বাজা শুরু হয়েছিল। এটা ছিল নর্তকীর ‘ব্রেক’ অর্থাৎ বিরতি।
অন্তিম পর্ব – এক সপ্তাহ পর