By A R Sarkar
“যাহা কাল ঘটিয়াছে কিম্বা তৎপূর্বে কখনও ঘটিয়াছিল তাহা সবই অতীত। তাহা কখনও পরিবর্তিত হইতে পারে না। কিন্তু যাহা তুমি আজ করিতেছ তাহা বর্তমান – তাহার পরিবর্তন তুমি করিতে পার। তাহাতে সুযোগ্য পরিবর্তন তোমার নিমিত্ত নির্ধারিত ভবিষ্যতকেও পরিবর্তিত করিয়া দিতে সক্ষম হইবে। আর এইরূপ হইলে তুমি তোমার ভাগ্য নিজেই গড়িতে পারিবে।”
এইরকমটাই তিনি বলতেন। চল্লিশ এর ঘরে পা দেওয়া রত্নাকর সান্যাল বাবার স্মৃতিচারণ করছিল দূরপাল্লার দ্রুতগতির ট্রেনে বসে। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে পাশে বসা তার অর্ধাঙ্গিনী। আর ক্ষনে ক্ষনে তাকে অতীত থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনছিল তাদের দুই পুত্রের পরে চার বছরের ছোট মেয়েটা।
হ্যাঁ, বাবার ব্রেন হ্যামারেজের খবর পেয়ে সকালের ফ্লাইটের অপেক্ষা না করে রাতের ট্রেনেই চড়ে বসেছিল রত্নাকর।
বাবা তার নামটা ‘রত্নাকর’ রেখেছিলেন এই বোধে যে ইহজন্মেই সে তার কৃত সমস্ত পাপ যেন পুণ্যতে পরিবর্তিত করতে পারে। আজকের হিসেবে নামটা একটু বেমানান ছিল বটে কিন্তু রত্নাকর তার অতিসৎ এবং কর্মনিষ্ঠ স্কুলমাস্টার পিতার প্রভাব বশতঃ এযাবৎ কোন অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়নি। সততার রাস্তায় চলতে চলতে অনেক স্বাভাবিক বাধা, উতার চড়াও অতিক্রম করে একটা সুযোগ্য শ্রেণীতে পৌঁছেছে বটে কিন্তু উদ্দেশ্য তার আরও অনেক ওপরের শ্রেণীতে পৌঁছানো। মন যেন তার বাঁধনছাড়া।
মনে পড়তে লাগল তার কয়েক বছর আগের কথা। বিরাট বড় কোম্পানির পাকা চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি এসে সে বলেছিল, “আমি ব্যবসা করবো। রাস্তা-পুল বানানোর ঠিকাদার(কনট্রাক্টর)। লাইসেন্স ইত্যাদির জন্যে পাঁচ লক্ষ টাকার দরকার।”
একমাত্র পুত্রের পিতার বোধহয় অপত্যস্নেহ একটু বেশী হয়। জমাপুঞ্জি সব ভাঙ্গিয়ে আরও ধার দেনা করে টাকা তিনি দিলেন বটে কিন্তু মুখে অনেকবার বোধহয় উপদেশমূলক ভাবেই বলতে থাকলেন, “আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন – আমি ভাবি – আমি অল্প আয় করিব, অল্প ব্যয় করিব – আর তাহার মধ্য হইতেই স্বল্প সঞ্চয় করিব। আর্থিক ভাবে উচ্চস্তরের জীবনযাপনে ভিন্ন ধরণের অনেক যাতনা রহিয়াছে – এইরূপ আমার বিশ্বাস এবং তাহাতে প্রায় সম্পূর্ণ সাধুতা রহিয়া থাকিলেও অসাধুতার লেশমাত্র নাই – এইরূপ কেহই হলপ করিয়া কহিতে পারে না।”
মাত্র তিন মাসেই অসাধু এক অলিখিত পার্টনারের খপ্পরে পড়ে সব টাকা হারিয়ে বর্ষাকালের এক সন্ধ্যেতে বাড়ি ফিরে এসে সব শোনানোর পর দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ হয়েছিল দোতালা বাড়ির গাড়ীবারান্দার টিনের চালের ওপর পড়া ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দে।
“বাবা, আমি ওইটা নেবো।” বায়না করে হকারের খেলনাগুলোর মধ্যে একটাকে দেখিয়ে মেয়ের দেওয়া ঝাঁকুনিতে তাৎক্ষণিক বর্তমানে ফিরেছিল রত্নাকর। তারপর বিনা বাক্যব্যায়ে স্ত্রীকে ইশারাতে অনুমতি দিয়ে পুনঃ স্মৃতিচারণে ব্যস্ত হয়ে বর্তমান আর অতীতের তুলনা করতে করতে ট্রেনের সফর পুরো করে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নার্সিংহোমে পৌঁছে গেছিল সে।
রত্নাকরের মনে হল বাকশক্তিহীন ফুডপাইপ যুক্ত মুখ দিয়ে মুহুর্মুহু নিঃশ্বাস ছেড়ে তার বাবা যেন বলছিলেন, “আসিয়াছ? তোমরা আসিয়াছ? আমি তোমাদিগের অপেক্ষায় প্রাণ ধরিয়া রাখিয়াছি। এইক্ষনে প্রাণ ত্যাগ করিলে আমার একমাত্র পুত্রের হাত হইতে মুখাগ্নি পাইবার সংশয় থাকিবে না। আমার পাশে আসিয়া বস। অনেক কথা কহিবার আছে।”
চার দিন হয়ে গেছিল বোন-ভগিনীপতিদের নার্স কোনদিন রোগীকে ওষুধ খাওয়ানোর কথা বলেনি। কিন্তু এইমাত্র কাকতালীয় ভাবে একজন পুরুষ নার্স এসে একটা বড়ি ঘুলে পাইপের মধ্য দিয়ে খাওয়ানোর কথা বলাতে রত্নাকর বড়িটি ঘুলে পাইপে দিয়ে আরও একটু জল দিতেই মনে হল তার বাবার শারীরিক যন্ত্রনা যেন কম হয়ে গেল। ঘুমে যেন তিনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।
অল্প কিছুক্ষন পরেই ডাক্তার জানিয়েছিল তার বাবা চিরনিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছেন।
রত্নাকরের মনে পড়ল শেষবারের মতো বিদেয় দেওয়ার সময় অশ্রুসজল চোখে তার বাবা বলেছিলেন, “আর একটিবার ভাবিয়া দ্যাখ – আমি যথাসাধ্য সাহায্য করিব তোমার পুত্রকন্যার পালন পোষণ নিমিত্ত। তুমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে ছাত্রছাত্রীদিগকে ইংরাজি কথন শিখাইয়া যাহা অর্জন করিবে তাহাতে সংকুলান হইয়া যাইবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুমি তোমার এই জন্মস্থানে থাকিয়া যাও। তোমার মাতা এবং আমি উভয়েই সুখী হইব। নচেৎ আমার আশীর্বাদ সর্বদা তোমাদিগের সাথে থাকিবে। তুমি সুখী হও।”
এই কথার রেশ ধরে রত্নাকরের স্মৃতি গোচর হল এরও কয়েকদিন আগেকার কথা।
“তুমি শিক্ষকতা কর। ব্যবসার কি বোঝ? আমি যা করছি তা সবার উন্নতির জন্য করছি। লক্ষ্যাধিক আয়ের জন্যে সমতুল্য মানসিকতার দরকার। তোমার মতো ছাপোষা গ্রাম্য স্কুলমাস্টারের মানসিকতাতে তা হবে না।”
পুত্রের এহেন উদ্দন্ডতা দেখে পিতার মনেও বোধহয় অল্প ক্রোধ হয়েছিল। আরও কিছু কটু শোনার পর তিনি বিরুপ হয়ে বলেছিলেন, “তুমি যাহা ভাবিতেছ তাহা সত্য হইলেও হইতে পারে। পূর্বজের এই বাস্তুভিটা তুমি বিক্রয় করিয়া দাও। ইহাতে আমি আমার অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়া তিল তিল করিয়া যাহা সংযোজন করিয়াছি তাহাও তুমি বিক্রয় করিয়া দাও। ইহাতে যদি তোমার লক্ষ্যাধিক অর্জনের পথ প্রশস্ত হয় হউক। আমি তোমার মাতাকে লইয়া অন্যত্র কোথাও চলিয়া যাইব। তুমি ব্যবসা কর। উন্নতি কর। আমার আর কিছু কহিবার নাই।”
রত্নাকরের মনে এরকম কিছুই ছিল না। সে ছিল অনেক বাস্তববাদী। সে তার বড় হওয়ার ইচ্ছাকে কখনও নিছক কল্পনার কুহকে ফেলে দেখেনি। সে বুঝল তার বাবার মনের গভীরের কোমল ভাগটাতে ধাক্কা লেগেছে।
শহর-নগরের প্রবাসী লোকেদের কাছে অনেক কাজ, অনেক চিন্তা থাকে। নিজের পরিবারের চিন্তা, গ্রামে অথবা পেছনে ফেলে আসা নিকট আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের চিন্তা। তাই তারা বস্তুভিত্তিক হয়ে যায়। গ্রামের লোকেদের কাছে থাকে অল্প একমুখী কাজ ও চিন্তা। তাদের বেশীরভাগ সময় আত্মকেন্দ্রিক কল্পনা কিম্বা অন্যের সমালোচনাতে কাটে। তারা নাটক-নভেল, সিনেমা-টিভির চরিত্রগুলোকে নিজেদের চরিত্রের সাথে মেলাতে চায়। আসলে তারাই হল বেশী কল্পনাপ্রবণ।
নির্বাক হয়ে ক্রোধ সংবরণ করে মহকুমা শহরে নেওয়া নিজের বাসার দিকে রওনা দিল রত্নাকর। তার মা স্বামী- ছেলের এই বচসাতে কাউকেও বিশেষ সমর্থন দিতে না পেরে নীরব দর্শক হয়ে ছেলেকে যেতে দেখতে থাকল।
পিতার শবদেহ কোলে সদ্য পূর্ব পরিচিতি এবং আড়ম্বর ফেরৎ পাওয়া রত্নাকরের চোখ থেকে অঝোর ঝরে জল গড়িয়ে যেতে থাকল। সমস্ত মান অভিমান ভুলে তার হৃদয়ের গভীর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল চিরন্তন সেই শ্লোকটি যার অর্থ আজ অনেকে বুঝেও বুঝতে চায় না।
পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতা হি পরমম্ তপঃ
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা।
শবদেহ সমেত কতিপয় আত্মীয়দের নিয়ে ‘মরচ্যুয়ারি ভ্যান’ ছুটে চলেছে শহর ছাড়িয়ে। সূর্যাস্তের আগে বাস্তুভিটাতে পৌঁছুতে হবে। নীরব রত্নাকরের অশ্রুসিক্ত চোখদুটোর সামনে যেন ভেসে উঠল কল্পিত তার বাবার আত্মার শান্ত প্রতিচ্ছবি। আর তখুনি তীব্র গতির ভ্যানের ইঞ্জিন আর বাইরের হর্নের শব্দেরও অনেক উচ্চে রত্নাকরের বাস্তবিক মন যেন তার পিতারই ভাষায় স্বতস্ফুর্ত বলে উঠল,
“আমায় ক্ষমা করিয়া দাও। ক্ষণকালের নিমিত্ত তোমা সম গুরুর সম্মুখে আমি ‘চণ্ডাল’ হইয়া গিয়াছিলাম। ইহ কারণেই আমাদিগের মধ্যিকার ব্যবধান সুদূর হইয়া গিয়াছিল। তোমার মনে ব্যাথা দিয়া বাস্তুভিটা বেচিয়া দিব এইরূপ ধারণা আমি কখনও কল্পনাও করি নাই। সততা এবং নিষ্ঠা আমি কোনোদিনই ত্যাগ করি নাই। আর কখনও করিব না। এই মুহূর্তে আমি তোমার সম্মুখে শপথ লইতেছি অদ্য হইতে আমি যাহাই করিব পরিবারের সুখসাচ্ছন্দের অতিরিক্ত দেশের ও দশের মঙ্গলের জন্য করিব। ইহাতে কদাপি কোন সংশয় রহিবে না। এমতাবস্থায় আমার বিনতি কেবল তুমি আমায় ক্ষমা করিয়া যাও।”