(ধারাবাহিক উপন্যাস)
গতকালের মত আজও মনে চরম অন্তর্দন্দ্ব, দুঃখ, হীনমন্যতা আর রাগ নিয়ে সাত সকালে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দামু একশো-দু ঘরের গ্রামের বাইরের মাঠের মধ্যে পরিত্যক্ত জলা পুকুরের পাড়ের বটগাছ পর্য্যন্ত পৌঁছে গেছিল।
মনে পড়েছিল তার গতকালের কথা। পূজা তার বুকে মাথা রেখে নির্মল একটু ভালোবাসা পেতে ছেয়েছিল। এমন সময় বিল্টন সিংহ আর তার দুই চেলা পাশের গাছগুলোর পেছন থেকে বেরিয়ে এলো। গালি দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছিল তাকে। দামু চলে যাবার পর নিজের দুই চেলাকে চলে যেতে বলে বিল্টন পূজার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ তার কামিজের জিপটা খুলে দিয়েছিলো।
দ্বিতীয় পর্ব
গরীবের বেদন
শব্দগুলো শেষ হওয়ার আগেই পূজা তার সমস্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে একটা স্ত্রীজনোচিত হুংকার মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে ফর্সা পিঠে খোলা জিপের কান ধরে রাস্তার দিকে দৌড়ল। আর তক্ষুনি সাইকেলের বেলটা আবার বেজে ওঠাতে বিল্টনের গলা থেকে আগুনে জল পড়ে ভুস করে ছাই উড়িয়ে দেওয়া শব্দের মতো আওয়াজের গালি বেরিয়ে এলো, “ শালী, নখরা দেখায় – কতদিন আর তুই – ”
সাইকেলওয়ালা দৃষ্টিগোচর হওয়াতে অসম্পূর্ণ মন্তব্যটার সাথে গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিল বিল্টন। আর তক্ষুনি কামিজের খোলা জিপটা টেনে মুখ ঘোরাতে গিয়ে ধম করে সাইকেলের ঠিক সামনে এসে পড়ল পূজা। বিব্রত পূজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপে টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে সাইকেল শুদ্ধু পড়ে গেল চালকটি।
***
ঝাপসা চোখে তার বাড়ী থেকে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া দামুকে দেখতে দেখতে পূজার মনে পড়ল সে শুধু সাইকেলওয়ালার পড়ে যাওয়ার শব্দটাই শুনেছিল কারণ তখন সে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ করে ছুটে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।
***
রোদ্দুর অনেকটা বেরিয়েছে যদিও ছোট ছোট খুপরির মতো জানালা দুটো দিয়ে ঢুকে আসা স্বল্প আলো দামুর বাড়ীটাকে এখনও পুরোপুরি অন্ধকারমুক্ত করতে পারেনি। শহরের বাড়তি চাহিদার খোলামেলা ফ্ল্যাটগুলোর সাথে গ্রামের অজস্র গরীবদের এইরকম ঘরগুলো ‘আকাশ-পাতাল পার্থক্যের’ জলজ্যান্ত উদাহরণ। শুধুমাত্র পেটে খেয়ে বাঁচার তাগাদায় সুন্দর আবাসের চাহিদা এখানে সুদূর-কল্প। দুই দেওয়ালের মধ্যে ঢোকানো বাঁশের থেকে কিছু এলোমেলো পুরোনো কাপড় ঝুলছে। এদিক সেদিক অগোছালোভাবে রাখা আছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র। মাটির দেওয়ালে আলাদা করে পেরেক ঠুকে ঝোলানো একটা ফুলপ্যান্ট আর পুরোহাতা জামা যেটা বোধহয় দামুর একমাত্র বাইরের পোশাক। ভেতরের দিকের দুটো ভাগে একটাতে রাখা কেরোসিন স্টোভ এবং কিছু কমাদামের বাসন-কোসন রান্না ঘরের অস্তিত্ব স্পষ্ট করছে। আর দ্বিতীয়টাতে রাখা একটা খাটিয়া আর গোটা দুই সাদা ও রংদার সাড়ীর সাথে এটা দামুর মা রাইমনি আর তার দিদি সন্ধ্যার যৌথ শয়ন স্থান বলে প্রতীত হচ্ছে। সামনের ভাগটাতে দামুর বাবা হরিরাম পোদ্দারের নিশ্চিত বরাদ্দ এক কাঠের খাটের ওপর কাঁথা চাদর দেখে দামুর ভাগ্যে ভূ-শয্যার স্পষ্টীকরণ হচ্ছে। এমতাবস্থায় এক কোনে বাঁশের থেকে ঝুলে থাকা পুরোনো ধুতি জামার নীচে আধভাঙ্গা চৌকিতে রাখা কৃষ্ণ ভগবানের এক ছোট মূর্তির মুখের অনবদ্য হাসি অবশ্যম্ভাবী নিয়তি আর বিধানের পরিপুষ্টি করে যেন হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ গীতার শতবার আওড়ানো না-বুঝ সেই পংক্তিটি বলছে, “ কর্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”(কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কক্ষনও নয়)
বাইরে কাশির আওয়াজ হরিরামের। তোলা জলে স্বামীকে স্নান করিয়ে নিয়ে এসে রাইমনি স্বামীর দেহের প্রায় পুরো ভার নিজের কাঁধে নিয়ে খাটে শোয়াতে শোয়াতে বলল, “ একটু সামলে।”
পুরো অকেজো ডানদিক নিয়ে বাঁ হাতের গাছের ডাল থেকে কাটা লাঠিটা ছেড়ে দিয়ে শুতে শুতে সমানে জবাব দিল হরিরাম, “ঠিক আছে রে।”
রাইমনি যেন একটু গরম স্বভাবের স্ত্রী। হতেই পারে। মেয়েমানুষের মাথায় যদি দারিদ্রের চরম সীমায় সংসারের সব ভার দেওয়া হয় তাহলে শরীর ও মনের সমস্ত রস ধীরে ধীরে শুকিয়ে ডাব থেকে নারকেলের খোলের মত শুষ্ক এবং কঠোর হয়ে যায়। শাঁস ছাড়ালে কি বেরোবে ভগবানই জানে। ঝট করে কথা কেটে দ্বিত্ব করে মুখ টেনে বলল সে, “ ঠিক আছে – হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে। দুনিয়া-ভরের সব রোগ যে পুষেছ।”
দীর্ঘ দিনের সকল দিক থেকে অভ্যস্ত হরিরাম বাঁ হাত দিয়ে বিছানার নীচ থেকে দামুরই এনে দেওয়া আধখালি বিড়ির বান্ডিলটা আর পুরোন লাইটারটা হাতড়ে বার করতে করতে স্বপক্ষ সমর্থন করল, “ আরে, মানুষ অসুখ কি ভগবানের কাছে মানসিক করে শরীরে আনে?”
পায়ের দিকটা চাদর দিয়ে ঢাকতে যাবে রাইমনির নজর পড়ল বিড়ির ওপর। ব্যস। চাদর ছেড়ে বিড়ির বান্ডিলটা ঝট করে ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “ না-না, মানসিক করে মোটেই নয়, জবরদস্তি করে ছিনিয়ে আনে। কতবার ডাক্তারের মানা করা সত্বেও এই সব ছাড়তে পার না। ‘দমা’(হাঁপানি) – ‘দিল’(হৃদয়)-এর রোগ আছে। খেলেই কাশি বাড়ে। কাশি বাড়লে রক্তচাপ বাড়ে আর রক্তচাপ – উঃ তোমারে কে বোঝায়! কোন লাভ নেই – হে ভগবান!”
মানসিক ভারসাম্য ব্যহত হলে হরিরামের এমনিতেই কাশি শুরু হয়ে যায়। কাশতে কাশতে ক্ষীণ প্রতিবাদ করে সে, “ আচ্ছা বাবা, এবারে চুপ কর। একবার শুরু হলে আর তো –”
কথা কেড়ে নেয় রাইমনি, “আর তো থামি না – তাই না? আরে বোঝা তো আমার মাথায়। তোমার চিন্তা কিসের? বিধবা বেটী কাজে যায় আর – ”
ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে দামুকে দোরগোড়ায় দেখে ঝাঁঝ তার বাড়ল। মাথা পিটে দামুর দিকে কটাক্ষ হানল সে। “ এই দ্যাখ, হে ভগবান! কি রে? বাবু হয়ে গেলি? ঘরে বসে ভাতের জোগাড় হয়ে যাবে?”
হরিরামের সমর্থন সর্বদাই একমাত্র পুত্র দামুর প্রতি। “আরে তাকে ঘরের ভেতর আসতে তো দে,” বলে নিজেই ডাকল, “আয়।”
কেন কে জানে রাইমনির আজ যেন রাগটা একটু বেশিই হয়েছে। ধমক দিল স্বামীকে, “ চুপ করো। তুমিই সায় দিয়ে মাথায় তুলেছো।” বলেই আবার দামুর দিকে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ল, “ হ্যাঁ বল, এমনি করলে ভাত জোগাড় হবে?”
চব্বিশ অতিক্রান্ত দামুরও কি আজ মাথা শান্ত? হাজির জবাব তার, “তো কাজে গেলে কি সোনা-দানা পেয়ে যাবো?”
চিবিয়ে টিপ্পনীটা পুনঃ উচ্চারণ করে জবাব দিল রাইমনি, “না, সোনা-দানা পাবি না। কিন্তু শুকনো রুটির আশা তো থাকবে।”
“শুকনো রুটি! হুঁ – খিদেয় মরার পরে? মজুরি তো দিচ্ছে না। কাজ করো – ভুখা মরো।”
“সন্ধ্যা যে যাচ্ছে?”
“মাথাতে নেই কিছু ওর। আরে অত সরল হলে চলে না। কাজে যাওয়া বন্ধ করলে টনক নড়বে মালিকের। কিন্তু একের দ্বারা কিছু হবে না।”
কাশি চেপে খুশি প্রকাশ করতে চাইল হরিরাম। রাইমনির যেন স্বাভাবিক অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে গেছিল। হাঁ করে সে বোঝার চেষ্টায় দামুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই রইল।
দামু যেন আজ এক বিদ্রোহী – এক সংগ্রামী। বলে চলে সে, “ সবাইকে এক সাথে, কোন ভেদাভেদ না রেখে, কাজ ছেড়ে দিতে হবে। তবেই মাথা নোয়াবে মালিক। আর এরকমটা সব জায়গায় যদি হয় তাহলে মালিক আর ভ্রষ্ট নেতাদের দ্বারা শোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। একটা নতুন সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হবে। কিন্তু শুরু তো কেউ একজনকে একদিন করতেই হবে। আর সেই একজন আমি কেন নই?”
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে রাইমনিকে হতচকিত করে পা পটকে সোজা সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ছেলে বড় হয়েছে – গন্ডীভিত্তিক চিন্তার বাইরে বুঝতে শিখেছে মনে করে খুশিতে হরিরামের চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল।
***
ইটভাটার আকাশ ছোঁয়া চিমনি দিয়ে বেরুনো সাদাকালো ধোঁয়া যেন নীচে কর্মরত শ্রমিকদের হাহুতাশ। তিন চার জায়গায় দলে দলে পুরুষ, স্ত্রী আর কিছু কম বয়সী ছেলে মেয়ে সঁপে দেওয়া আলাদা আলাদা কাজ করে চলেছে। কাঁচা আর পাকা ইটের থাক মাথায় নিয়ে ভারসাম্য রেখে চলমান কিছু মহিলার সাড়ীর আঁচল ধরে ধরে একটু একটু করে দৌড়োচ্ছে তাদের লেংটো কচি কচি ছেলেমেয়েগুলো। দেখে মনে হয় না বিশেষ কোন পূজা পার্বণ ছাড়া তাদের গায়ে কাপড় থাকে। এক কোনাতে পাকা থাক করে রাখা ইটের বানানো ছোট এক অফিস ঘর। তার সামনে টেবিল-চেয়ার পেতে বসা এক প্রৌঢ় সাবেকী আমলের চশমার সাথে মুনিম এবং ম্যানেজার দুই ব্যক্তিত্বই প্রদর্শন করছে। নাম তার টেকচাঁদ বলে কিছু একটা ছিল বটে কিন্তু মালিক এবং কর্মচারী সবাই এখন তাকে ‘মুনিম’ বলেই জানে এবং ডাকে। টেবিলের ওপর একটা বহিখাতা, জাল করে ছাপানো বিল বই, রসীদ বই এবং একটা কাঁচা খাতা ধরনের পড়ে আছে। টেবিলের অনতিদূরে চারজন শ্রমিক – তিন বৃদ্ধ ও এক তিরিশ অতিক্রান্ত যুবক নীচুস্বরে কিছু বার্তালাপ করছে যার কিঞ্চিত মুনিমের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও সম্পূর্ণ অর্থ বুঝে উঠতে না পেরে সে অন্য দিকে দেখার ভান করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে।
প্রথম শ্রমিকের দাবি, “মাইনে তো এবারে দিতেই হবে। না হলে ঘর চলবে কি করে?”
দ্বিতীয় শ্রমিক শীর্ণকায় বনবারীলাল এই কথনের পুষ্টিকরণ করে নিজ দুঃখ জ্ঞাপন করে বলল, “আমার ছগনিয়া(ছগন লাল)র তো দু’দিন ধরে জ্বর। আজ আবার ছুটন – ছগনের বেটা, আমার নাতি – তারও জ্বর ধরেছে। এখন বিনা ওষুধে বড়রাতো বিছানা কামড়ে পড়ে থেকে রোগ সহ্য করতে পারে কিন্তু বাচ্চাদের তো ওষুধ পত্র –”
বাক্যপূর্তি করল বয়োবৃদ্ধ জুবেদ আলি খান, “ – দিতেই হবে। তিন সপ্তাহ হয়ে গেল। আরে কমপক্ষে এক সপ্তাহের মজুরি তো দিক। আমার দোকানওয়ালা তো স্পষ্ট শুনিয়েছে আর ধার দেবে না। না ডাল – না চাল । এখন তো –”
ফোড়ন কাটল যুবক রামদীন, “উপোষ করে মরতে হবে। না কাকা, আমি তো শহর চলে যাবো। কারখানায় লেগে যাবো। ভানু – আমার শালা – সে তো চলে গেল। ওখানে মাইনেও বেশি আর সময়মতো দেয়ও – প্রতি মাসের সাত তারিখে। অগ্রিম পয়সাও দেয়। এখনতো এখানকার মাইনেটা পেয়ে গেলেই – ব্যস।”
মাথা নেড়ে বনবারী তার নাকারাত্মক প্রতিবেদন স্পষ্ট করল, “ সবাই তো আর শহর যেতে পারে না। কাজ তো আমাদের এখানেই করতে হবে। শুধু মজুরিটা যেন সময় মতো পাই।”
“কাকা,” জেনেশুনেই বোধহয় ডান হাতটা নাড়িয়ে চোখটা ট্যাড়া করে গলার স্বর দু’গুণ করল রামদীন, “ কাজ বন্ধ করে দাও – মাইনে বাধ্য হয়ে দেবে। হ্যাঁ।”
নির্বাক বনবারীর বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে প্রথম শ্রমিক এবং জুবেদের সমর্থন উচ্চারিত হল, “হ্যাঁ, এটাই এখন রাস্তা।”
ধৈর্য্য সহকারে কান পেতে থাকা মুনিমের বোধগম্য হয়েছিল রামদীনের শব্দ কয়টি। সটান উঠে দাঁড়িয়ে সর্বদা প্রশ্নচিহ্ন মুখ থেকে বাক্যবাণ ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে এল। “কি ফুসুর-ফুসুর হচ্ছে রে? কি বন্ধ করবিরে তুই? কাজ বন্ধ করবি? অ্যাঁ?”
অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঠেলায় পড়ে ঠেকা দেওয়ার মত কাঁচু কাঁচু করে বলল রামদীন, “আর নয়তো কি? মাইনে না দিলে – কাজ – আমরা – বন্ধ করে দেবো। আর কতদিন পর্য্যন্ত –”
কথা কেড়ে শ্লেষ বাক্য মুনিমের, “আর কতদিন? যেন ছ’মাস হয়ে গেছে? ইট বিক্রি করে মালিক পালিয়ে যাবে? অ্যাঁ?”
“আজ্ঞে, আমি সেরকম তো বলছি না। আমি তো – ”
“তো কিরকম বলছিস শুনি?”
আমতা আমতা করল রামদীন, “ আজ্ঞে, আমি বলছিলাম – মানে – তিন সপ্তাহ হয়ে গেল – সবার কষ্ট – সবারই চিন্তা – কি গো কাকা? তাই না?”
সবাইকে স্তম্ভিত করে মুনিমের স্বভাবজাত চেবানো উচ্চস্বর বেরুলো, “কার চিন্তা? কার কষ্ট? আরে মাইনে পালিয়ে যাচ্ছে না কোথাও। কামচোর যারা তারাই শুধু মাইনে মাইনে করতে থাকে। বুঝলি?”
বনবারী স্বপক্ষ নিল, “ না মুনিমজী, তা নয়। কষ্ট সবার।” তারপর একটু উঁচু কিন্তু গম্ভীর স্বরে পার্শ্ববর্তী সবাইকে সম্বোধন করল, “ বলো ভাইসব, কামচোরের উপাধি যে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
কিছু শ্রমিক যারা বসে ইট বানাচ্ছিল, ফার্মা রেখে উঠে দাঁড়াল ব্যাপার বোঝার জন্যে। যারা ইট আনার জন্যে যাচ্ছিল তারাও দাঁড়িয়ে পড়ল কথা শোনার জন্যে। মুনিমের প্রশ্নবাচক মুখে চিন্তা আর বিস্ময়ের মিশ্রিত ছাপ দেখা দিল। হঠাৎ সাহস জোগাড় করে সবার সাথে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রথম শ্রমিক যেন প্রাথমিকতা পেতে চেয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কামচোর নই আমরা। কিন্তু এখন আমরা কাজ বন্ধ করে দেবো। মাইনে পেলে পরে কাজ চালু হবে। কি বলো ভাইসব?”
চারদিকে গুঞ্জনধ্বনি। বিভিন্ন কণ্ঠস্বর থেকে প্রথম শ্রমিকের উক্তির মিশ্রিত অংশ বিশেষ ‘কাম বন্ধ’ –এর নারা অর্থাৎ স্লোগান হয়ে ধ্বনিত – প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। “হ্যাঁ-হ্যাঁ কাজ বন্ধ।” “ মাইনে পেলে কাজ চালু।” “ আমরা কামচোর নই।”
কাঁচা ও পাকা ইটের থাক মাথায় যারা আসছিল বা যাচ্ছিল তারা বোধহয় মাথার ভারের সন্তুলন হারানোর ভয়ে বাকীদের সাথে সুর মেলাতে না পেরে কিছু কৌতূহলী দৃষ্টি আর কিছু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেমে দাঁড়াল।
বনবারীর কণ্ঠে এখনও অনুনয়, “ মুনিমজী, এবারে তো কিছু পয়সা দিয়ে দাও।”
ঝাঁঝিয়ে উঠল মুনিম, “ আরে কি করে দিই ‘পয়সা’? এই ইট ভাঁটা কি আমার বাপের?”
আরো অনেক কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়ে চুপ করে গেল মালিকের পুরোন জীপগাড়ির ব্রেকের ‘ক্যাঁচ’ করে ওঠা শব্দে।
মুনিম সমেত সবাই সেই দিকে তাকাল। ভারী ভরকম পেট মোটা শরীরের টাক পড়া মাথার প্রৌঢ় মালিক চালকের সীট থেকে নেমে সোজা পা চালাল ভিড়ের দিকে বটে কিন্তু নজর তার সব দিকে। মানসিকতার সাথে মিল খাওয়ানো নাম তার রত্নাকর সিংহ। যেই না দেখা মালিককে সবাই ছড়িয়ে গেল এদিক সেদিক আর সামলে নিয়ে মুনিম বন্ধ করল তার হাঁ করে খোলা মুখটা।
দামুর বত্রিশ বর্ষীয়া সন্তানহীনা বিধবা দিদি সন্ধ্যা মাথায় কাঁচা ইটের থাক নিয়ে দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টায় আচমকা ধাক্কা খেল অন্যদিক থেকে ধেয়ে আসা এক বছর বারোর কিশোরের সাথে। ইটগুলো ভারসাম্য হারিয়ে পড়ল মাটিতে। খান দুই দু’টুকরো হয়ে গেল। ইটগুলোকে তুলে আবার মাথায় থাক তৈরি করার জন্যে ঝুঁকে যাওয়া সন্ধ্যার কোমরের নগ্ন উপরিভাগ দূর থেকে চোখে পড়ল রত্নাকরের। সোজা গিয়ে কিশোরকে দিল এক ধাক্কা। “কিরে? মেয়েছেলের পেছনে ছুটিস? দ্যাখ কত লোকসান করে দিলি! দ্যাখ।” কথাগুলো বলেই আর একবার ধাক্কা দিল কিশোরকে যে শুধু ‘লোকসান’ কথাটা ছাড়া আর কিছু বুঝে উঠতে না পেরে মাথা হেঁট করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। রত্নাকরের বক্র দৃষ্টি এবার পৌঁছুল সাদা শাড়ির ভাঁজ থেকে উঁকি দেওয়া সন্ধ্যার উন্নত বক্ষস্থলে। কিশোরকে ভুলে একটু স্পর্শ পাওয়ার বহুদিনের অদম্য ইচ্ছেতে সে হঠাৎই বাম হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলল সন্ধ্যার পিঠটা।
“আ-হাহা, কোথাও লাগল নাকি?”
এমতাবস্থায় রমণীর স্বভাবজাত বিদ্যুতগতির প্রতিক্রিয়ায় ছিটকে দাঁড়াল সন্ধ্যা। প্রথমে বিস্ময় এবং পরমুহুর্তে সম্ভ্রমের সাথে ছোট জবাব তার, “ না মালিক।”
রত্নাকর নিজের অসফলতা অনুভব করে মনে মনে তিক্ত হয়ে উঠে ধুতির সাথে বিনা ফিতের বুট পরা পা দুটোকে সজোরে চালিয়ে দিল মূল ঘটনাস্থলের দিকে।
সন্ধ্যা ইটগুলো গুছিয়ে নিয়ে নিজের গন্তব্যস্থলের দিকে চলল। বেশির ভাগ লোক নিজের নিজের কাজে জুটে গেলেও কিছু এখনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রত্নাকরের ধমক সোজা মুনিমকেই। “কি হচ্ছে এসব? কাজ বন্ধ করে কি পাঠ পড়াচ্ছ এদের মুনিম?”
হাজির জবাবী মুনিম মুখ খুলল, “ মালিক, এরা বলছে কাজ বন্ধ করে দেবে।” পরমুহুর্তে রামদীনের দিকে ইশারা করে ব্যঙ্গোক্তি করল, “আর ইনি হচ্ছেন লিডার।”
শেষ শব্দটা রত্নাকরও ব্যঙ্গ করে পুনরোচ্চারণ করল, “ লি-ডার, বাহ!” তারপর একটু খুঁটিয়ে দেখতেই রামদীনের প্রতি তার মনোভাব একেবারেই বদলে গেল। কাঁচা পাকা ভুরু উঠিয়ে হাসি চাপা ঠোঁট দুটো খুলে বলল, “তুই রামদীন না? তোর বউও তো – ” জেনে শুনেই থেমে যায় রত্নাকর। রামদীনের স্বল্প উপস্থিত বুদ্ধি কাজ করে। “হ্যাঁ মালিক, ও তো আজ তিন দিন হল – ” আমতা করে বলে, “ শরীরটা – খারাপ – তাই আসেনি –কাজে।”
রত্নাকরের মনে পড়ে যায় এইরকমই এক শরীর খারাপের দিনে ঘামে ভেজা অসম্পূর্ণ সহবাস তার রামদীনের বর্তমান অনুপস্থিত বউয়ের সাথে। অসম্পূর্ণ হলেও সামুহিক চাহিদা পূর্তি হয়েছিল তার। আর পুরো দশটা টাকা বখশিশ হিসাবে দিয়েছিল সে ধুতি দিয়ে নিজের মুখের ঘাম মুছতে মুছতে। আর মুঠোর মধ্যে নোটটা নিয়ে শাড়ি ঠিক করে ঘোমটা টেনে শারীরিক এবং আর্থিক উভয় চাহিদা মেটানোর আনন্দে চাপা হাসির সাথে বিদায় নিয়েছিল রামদীনের বউ থাক ইটের গরম ঘরটা থেকে। এইরকম দশ টাকা বা পাঁচ টাকা তো অনেকজনকেই বিলিয়ে দেয় রত্নাকর তার অসম্পূর্ণ কিম্বা কিঞ্চিত সম্পূর্ণ সহবাসের দাম স্বরূপ। কিন্তু রামদীনের বউয়ের কথা যেন একেবারেই ভিন্ন।
ভাবাবেগে শারীরিক এবং মানসিক গোলযোগের উৎপত্তিকে সামাল দিতে সর্বজনবিদিত বিজ্ঞানের পুনঃ প্রচার দিয়েই বাকশক্তি ফিরিয়ে আনল রত্নাকর। “ হ্যাঁ – হ্যাঁ, স্ত্রীলোক যে – শরীর খারাপ তো হবেই। কিন্তু, ও কাজ খুব ভাল করে। আর তুই ও তো ভাল কারিগর। কিন্তু এ আমি কি শুনছি! তুই দেশ শুধরনোর কাজে লেগে গেছিস?”
ক্রোধ, মোহ আর ভালোবাসা