ইম্পোর্টেড রাশিয়ান ভোদকার বড় এক পেগের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মেঘনা বাইরের হলঘরের শোরগোল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কি অছিলায় যে রান্নাঘরের দিকে এগিয়েছিল তা তার নিজেরই বোধগম্য ছিল না। কিন্তু রান্নাঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কিছুক্ষণ আগে উদ্রেক হওয়া নিজের ভেতরের গুমরানো ভাবটা তার রক্তচক্ষুর ওপরে ভেজা বাষ্প হয়ে দেখা দিল।
* * *
পাঞ্জাব তথা ভারতের ঐতিহাসিক শহর অমৃতসরের এক ধনী পরিবার থেকে আসা এই মেঘনা আগরওয়াল আজ আঠাশে পা দিল। স্কুল কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এক দুটো পুরষ্কার পাওয়া শৈশবে ফুটফুটে মা বাবার অতি আদুরে তৃতীয়া এবং কনিষ্ঠা সন্তান এই মেঘনা একটু বেশী বয়সে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়ে চার বছর আগে মডেলিং করে হিন্দি ছবির নায়িকা হওয়ার তীব্র আশা নিয়ে পরিবারের পরিচিত এবং কলেজের এক স্বল্পমেয়াদী গুপ্ত প্রেমিকের প্ররোচনায় পরিবারের সম্মতি সাপেক্ষে মুম্বাই চলে এসেছিল সম্পূর্ণ একা।
পুরো দস্তুর নিম্ন মানের এক ছোট প্রতিষ্ঠানের তিন মাসের অতি ব্যায়সাধ্য এক মডেলিং কোর্সে প্রবেশ নিয়ে অসমবয়সী বয়োজ্যেষ্ঠ তিন জন মেয়ের সাথে শেয়ার করে গোরেগাঁও এর সস্তা এলাকার এক ফ্ল্যাটে থাকতে আরম্ভ করেছিল মেঘনা তার প্রেমিকের নির্দেশে।
তিন ঘণ্টার মডেলিং ক্লাস শেষ করে দুঘণ্টা নাচের ক্লাস হয়ে বাকী সময়টা প্রেমিকের সাথেই কাটাত সে। বেশীর ভাগ দিন নিজের পয়সায় প্রেমিকের সাথে ডিনার করে ফ্ল্যাটে ফিরে নায়িকা হতে আর বেশীদিন নেই এমনটা কল্পনা করতে করতে এলোপাথাড়ি স্বপ্নের মধ্য দিয়ে রাত কাটিয়ে আবার নতুন দিন শুরু করত সুন্দরী মেঘনা।
মুম্বাইয়ের মতো অতি রঙ্গিন মহানগরীতে তিন মাস কাটানো যেন মাত্র তিন সপ্তাহের মতোই লেগেছিল মেঘনার। কিন্তু তার পরেই শুরু হয়েছিল তার সত্যকার জীবন সংগ্রাম।
কাজ খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে প্রেমিকটি মেঘনার সাথে তার ফ্ল্যাটে আসতে আরম্ভ করেছিল আর বাকীদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মেরে আজগুবি সমস্ত বলিউডের গল্প শুনিয়ে তাদের সামুহিক আকর্ষণ কেড়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল। দীর্ঘ ছমাস ধরে অনেক জায়গায় অডিশনের আলাদা পয়সা দিয়ে অতি নিম্ন মানের মাত্র দুটো ভোজপুরী ছবিতে এক্সট্রার কাজ পেয়ে উদ্যম হারিয়ে ফেলাতে প্রেমিকটি সান্তনা দেওয়ার অছিলায় মেঘনার একলা থাকা অবস্থায় প্রায়ই দিনের বেলা তার ফ্ল্যাটে দাখিল হতো এবং এই ভাবে চলতে চলতে অনেক চেষ্টার পর একদিন মেঘনার ভেঙ্গে পড়া আবেগপূর্ণ এক মানসিক স্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রেমিকটি প্রথমবার তার দীর্ঘ আকাঙ্খিত শারীরিক ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে সক্ষম হয়েছিল। আর সেই দিন প্রথমবার তথাকথিতভাবে সবকিছু হারানোর পর মেয়েলিপনা উবে গিয়ে এক খোলা মনের ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছিল মেঘনার মধ্যে। আর সেটা নীতিগতভাবে শুধু বলিউড কেন সমগ্র অভিনয় জগতে উঠে দাঁড়ানোর নাকি একটা প্রশস্ত পথ।
“আমি বাড়ী থেকে আর টাকা নিতে চাইছি না। ফ্যাক্টরি এখন দাদা চালায়। ও জানে না আমি তোমার খরচাও চালাচ্ছি। তুমি একটা চাকরী কেন খুঁজছ না? ” এতদিনের পরনির্ভর চরিত্রটা মেঘনার স্বনির্ভর এবং প্রভাবি হয়ে উঠল। প্রেমিকের আমতা আমতা করে অনিচ্ছাকৃতভাবে “হ্যাঁ” বলাতে মেঘনা তার এ পর্যন্ত প্রাপ্ত কঠোর বাস্তবের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করল, “ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্ট্রাগল আমি এখন বুঝে গেছি। কারোর সাথে সাথে ঘুরে কিছু হবে না। তুমি নিজের জন্যে একটা কাজ দ্যাখ।”
শারীরিক চাহিদা মেটাতে আর্থিক পতন সহ্য করতে হয়েছিল প্রেমিককে।
মাস খানিক পরে একদিন দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকে তার আট বছরের বড় সিনিয়র রুমমেটটির সাথে আলুথালু বেশে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পেল মেঘনা প্রেমিকটিকে। আর বিনা বাক্য ব্যয়ে সেদিন থেকে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষা জনিত রোগগ্রস্ত এবং অন্যের নাম-টাম নিয়ে প্যানপ্যানানি না করা মেঘনা এই প্রেমিককে চিরতরে তার স্মৃতি থেকে মুছে ফেলল বটে কিন্তু নাম তার একটা ছিল – ‘দেবিন্দর’। বাংলা কিংবা হিন্দিতে যা হল ‘দেবেন্দ্র’। দাড়ি-পাগড়ী না রাখা এই শিখ যুবকের নামটা তার চরিত্রের সাথে যথেষ্ট বেমানান শোনায় বটে কিন্তু মাতৃক্রোড়ে উপযুক্ত শিক্ষা ও সংস্কারের অভাবে আমাদের সমাজের আনাচে কানাচে প্রায় সর্বত্র এইরকম বেমানান নামের অসংখ্য চরিত্র বিদ্যমান।
বয়োজ্যেষ্ঠ তিরিশ অতিক্রান্তা কুমারী মহিলাটি এক কল সেন্টারে শিফটিং ডিউটিতে কাজ করত। যাইহোক পরে মেঘনা জেনেছিল দেবিন্দর উরফ প্রেমিকটি নানান চাহিদার কারণে তার এই ফ্ল্যাট-মেট কুমারী মহিলার পাইয়ে দেওয়া কল সেন্টারের চাকরীরর আড়ে আড়ে এক ‘পিম্প’ এর কাজও করা শুরু করে দিয়েছিল। আর এতদিনে সে লোকমুখে সরস প্রচারিত চলচ্চিত্র জগতের কটু সত্যটাও অনুভব করেছিল যে মেয়েদের তারকার পরিচিতি পেতে হলে কুমারীত্ব বিসর্জনের সাথে সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পর্যাপ্ত ধনরাশির বিনিয়োগ অপরিহার্য। তার পরে থাকে ভাগ্যফল। ছোট পর্দা আর ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারগুলো সব রঙ্গিন করে ধনাত্মক ভাবে সাজানো। আসলে কিন্তু সব ভাঁওতা।
এই জ্ঞানচক্ষু খুলে যেতেই প্রতিদিন মোবাইল ফোনের অ্যাড্রেস বুক ধরে ধরে ব্যাক্তিগত মীটিং এবং রাতের পার্টীর জোগাড় খুঁজে বার করতে থাকল বেপরোয়া মেঘনা। আর তারপর চমৎকার হতে বেশী দেরী লাগল না। যদিও বড় পর্দা পর্যন্ত নাগাল তার পৌঁছুল না কিন্তু ছোট পর্দায় বেশ কটা মেগাসিরিয়ালে অল্প স্বল্প সংলাপের সাথে দেখা গেল তাকে। নিজের দাম্ভিক চরিত্রের কারণে নায়িকার ভূমিকা এখানেও সুদূরকল্প থেকে গেলেও মাসে আঠারো-কুড়ি দিনের মতো শুটিং এ ব্যস্ত থেকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ী কিনে স্বাধীন ভাবে এক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নিজের মতো করে থাকতে পেরেছিল সে মাত্র তিন মাসের মাথায়।
না, তার এই চমৎকারী ভবিষ্যৎ বদলের পেছনে তার নিজের কৃতিত্ব শুধু লোক খুঁজে বার করা ছাড়া আর বেশী কিছু ছিল না।
আসলে সংঘর্ষময় বলিউড পর্বের প্রথম বার্ষিকীর ঠিক পরে পরেই নতুন বৌদির দর্শন করে শেষ বারের মতো বাড়ী থেকে পয়সা নিয়ে ফেরত আসার সময় এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে আলাপ হয়েছিল তার নীলেশের সাথে। চল্লিশের কোঠায় পা দেওয়া আঠারো-কুড়ির মানসিকতা যুক্ত এক ডায়মন্ড মার্চেন্ট এই নীলেশের বিশেষ অবস্থায় পড়ে ইকনমি ক্লাসের ফ্লাইট নেওয়ার দুর্ভাগ্যটা মেঘনার কাছে সৌভাগ্য হয়ে গিয়েছিল। এয়ার হোস্টেস কে বলে সীট বদল করে পাশাপাশি বসে তিন ঘণ্টার সফর কাটিয়ে মুম্বাই পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রাথমিক আলাপ ঘনিষ্টতায় বদলে গিয়েছিল। তারপর এই নীলেশই নিজের নিঃসন্তান এবং বিপত্নীক থাকার একাকীত্বের বোঝা লাঘব করার বিনিময়ে বিভিন্ন ছোট বড় টিভি সিরিয়াল প্রোডাকশন হাউসে কাজ পাইয়ে দিয়েছিল মেঘনাকে।
দু’দিনের ছুটি কাটাতে দুবাই গিয়ে হোটেলের মখমলি বিছানায় বিয়ারের গ্লাস হাতে নিয়ে নীলেশ বলেছিল, “ফ্ল্যাটটা বদলে নাও, মেঘু। কমপক্ষে আমার আসা যাওয়ার মতো তো হোক। অল্প একটু পার্কিং-এর জায়গা তো থাকুক।”
“তিন চার লক্ষ টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিটটা তুমি দিয়ে দাও। ভাড়াটা না হয় আমি দিতে থাকবো। কালকে গিয়েই বদলে নিচ্ছি।” নির্দ্বিধায় হেসে ঠাট্টার ছলে মেঘনা কথাটা বলেছিল বটে কিন্তু মনে তার বিশ্বাস ছিল যে স্ট্যাটাস বাড়ানোর ডোজটা সে ঠিকই দিতে পেরেছে।
দুবাই থেকে ফেরত এসে নীলেশ দালাল ধরে তিন লক্ষ টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট দিয়ে তার কমিশন বাবদ এক মাসের ভাড়া আশি হাজারও চুকিয়ে মেঘনাকে শিফট করিয়ে দিয়েছিল অন্ধেরীর এক আভিজাত্য সম্পন্ন এলাকায় বেসমেন্টে পারকিং ওয়ালা দুই বেডরুমের সম্পূর্ণ আসবাবযুক্ত সুন্দর বর্তমান এই ফ্ল্যাটটিতে।
তারপর থেকে দিন-দুপুরে এ.সি. যুক্ত বেডরুমটা পর্দা দিয়ে অন্ধকার করে মদের ঘোরে অতি আবেগে মেঘনাকে বার তিনেক বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল নীলেশ যা অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেঘনার পছন্দের বাইরে থেকে গিয়েছিল। মেঘনা কুমারী – মেঘনা মালিনী ইত্যাদি সেকেলের বেমানান নামগুলোর অনেক ওপরে যেতে হবে এমন ধারণাটা সে নিজের মনের মধ্যে বসিয়ে রেখেছিল। ছোট পর্দায় তো তার কোন নামই নেই। যা আছে তা শুধু পেমেন্ট স্লিপে। এই মানসিকতার সাথে সাথে আকাঙ্খাপূর্তি না হওয়াতে মেঘনার মধ্যে জন্মেছিল এক বিকার – যা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভাষায় ‘নিম্ফোম্যানিয়া’ বলে উল্লেখিত হয়। রোগের নামটা শুধুমাত্র সেই মহিলাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা বিভিন্ন পুরুষ সংগ ছাড়া থাকতে পারে না এবং পুরুষসঙ্গ না পেলে তাদের মানসিক অবস্থা নানাভাবে হীন হয়ে ওঠে।
অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিগত আড়াই বছরেরও একটু বেশী সময় নির্বিঘ্নে কেটেছিল বটে কিন্তু গত পরশু সন্ধ্যের পরে মেঘনার মানা করা সত্ত্বেও নীলেশ এসে পড়ল সোজা তার ফ্ল্যাটে। গেস্ট রেজিস্টারে নাম লেখার সময় হঠাৎ তার নজর গিয়েছিল ২৪০৬ নম্বর ফ্ল্যাটের আর এক এন্ট্রির দিকে। চব্বিশ তলার ছয় নম্বর এই ফ্ল্যাটটা নীলেশই মেঘনাকে পাইয়ে দিয়েছিল অংকবিজ্ঞানের হিসেব মতো অভিনয় জগতে মেঘনার টিকে থাকার আর নিজের হোটেলের খরচা বাঁচানোর জন্যে। কিন্তু আজ মেঘনার ফ্যাকাসে পড়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকাতেই তার মনে হল ফ্ল্যাটটা অন্য কারণে অন্যের জন্যেও বোধহয় ব্যবহার হচ্ছে।
“তোমার শরীর কেমন?”
“ওহো! নীলেশ, তুমি না – বড্ড বেশী চিন্তা কর। আমি – ঠিক আছি। তুমি মন খারাপ করবে তাই – আসতে – না করেছিলাম। এসো না – ভেতরে এসো।” আমতা আমতা করে বলেছিল মেঘনা।
কেমন একটা অস্বস্তির জন্যে ভেতরে আসতে মন চাইছিল না নীলেশের। তবুও অভ্যেস মতো ঢুকে বেডরুমের দিকে এগোতেই দেখতে পেল বাইরের বাথরুম থেকে জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে আসা এক অপরিচিত লোককে। অপ্রস্তুতে পড়ে আর কিছু খুঁজে না পেয়ে হঠাৎই মেঘনা বলে উঠল, “মীট মিস্টার সাক্সেনা, নতুন একটা সিরিয়ালের প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর। আর মিস্টার সাক্সেনা, ইনি নীলেশ আমার ফ্রেন্ড।”
গোঁজামিলটা নীলেশের হজম হল না বুঝতে পেরে সাক্সেনা বলে উঠল, “আচ্ছা, আমি তাহলে এখন আসি।”
“হ্যাঁ – হ্যাঁ। প্রোজেক্টের ব্যাপারে আমি ফোনে জানিয়ে দেবো। ধন্যবাদ।”
সময় ছিল রাত্রি সাড়ে আটটা। নীলেশের মনে পড়ল রেজিস্টারে সে দেখেছিল এই অতিথির আসার সময়টা – চারটে দশ। মাঝখানে অন্য কোন এন্ট্রি ছিল না। বেরিয়ে যাওয়ার সময়টাও লেখা ছিল না। তাহলে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা কি এমন প্রোজেক্ট আলোচনা চলছিল? তাও আবার টিভি সিরিয়াল – যার রাইটাররাই জানে না চার পাঁচ এপিসোডের আগে কি লিখবে।
“কি হচ্ছে এ সব, মেঘু?”
“একটা নতুন ডি.ডি.(দূরদর্শন) এর সিরিয়াল – ”
“বোকা বানিয়ো না। আমার কপালের ওপর ওই শব্দটা লেখা আছে কি? ভুলে যেও না আমিই তোমায় এই লাইনে – সিরিয়াল লাইনে দাঁড় করিয়েছি। সাড়ে চার ঘণ্টা!”
“ সাড়ে – চা – ” মেঘনা বুঝে গেছিল নীলেশ নিশ্চয়ই সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে খবর নিয়েছে।
সত্যিই তাই । নীলেশ হেসে একশো টাকার একটা নোট দিয়ে এসেছিল গার্ডকে সিকিউরিটি রুল হিসেবে ফোন করে মেঘনা কে খবর না করার জন্যে।
“হ্যাঁ, সাড়ে চার ঘণ্টা – কি এমন প্রোজেক্ট ছিল যা এতক্ষণ – ” রাগের চোটে বাক্য পূর্তি করতে না পেরে আক্রোশে শুধু মাথা নাড়ল নীলেশ।
“ওহো! তুমি এত হাইপার হচ্ছ কেন? এমনভাবে বলছ যেন আমি তোমার বিয়ে করা বউ। তা – এখন দাঁড়িয়ে থাকবে না ভেতরে আসবে?” হাসিচ্ছলে কথা ঘোরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হল মেঘনার।
“কি বললে? – এটাই বাকী ছিল? বিয়ের প্রস্তাবটা তুমিই নাকজ করেছিলে। যাই হোক – এটা রাখো। পরশু কাজে লাগবে। আমার তরফ থেকে গিফটই মনে করে নাও।”
না গুণেই প্রায় গোটা পনেরো কুড়ি মতো দু হাজার টাকার করকরে নোট পুরোপুরি পেটমোটা মানিব্যাগটা থেকে বের করে পাশের ডাইনিং টেবিলটাতে রেখে সোজা বাইরে গিয়ে সপাটে দরজাটা টেনে বন্ধ করে নিল নীলেশ।”
“আরে! যাচ্ছ কোথায়? শোনো – ” বলে এগিয়ে গিয়ে দরজা না খুলেই আই-হোল দিয়ে দেখেছিল মেঘনা নীলেশকে সোজা হনহনিয়ে লিফটের দিকে চলে যেতে। সীন ক্রীয়েট করতে চায়নি বলে সে বাইরে না বেরিয়ে চট করে সেল ফোনে নীলেশকে কল করেছিল। কিন্তু উপর্যুপরি দুবার নীলেশের কল কেটে দেওয়াতে সে নিজেকেই বলেছিল, “পরশু পর্যন্ত তুমি থাকতে পারবে না, নীলেশ। আসবে তো তুমি আমারই কাছে।”
* * *
পরশুর সেই ঘটনার পর থেকে একবারও কল করেনি নীলেশ মেঘনাকে। বরং মেঘনার গতকাল বিভিন্ন সময়ে প্রায় পনেরো বারের বেশী করা কলগুলো হয় কেটে দিয়েছিল নয়তো ছেড়ে দিয়েছিল নীলেশ।
রাতে একা উপর্যুপরি তিন বড় পেগ হুইস্কি চড়িয়ে নেশার ঘোরে টানা ঘুম দিয়েছিল মেঘনা আজ দশটাতে কাজের বউয়ের দরজার বেল বাজিয়ে দরজা চাপড়ানো পর্যন্ত। বিরক্তির সাথে উঠে দরজা খুলে দিয়ে গরগর করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। বউটা যথারীতি ধোয়ামোছা শেষ করে বাইরের থেকে দরজা টেনে বন্ধ করে চলে গিয়েছিল। স্বপ্নের মধ্যে বোধ হয় অতীত দর্শন করে হঠাৎ উঠে পড়ে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হিসেব করে জেনেছিল মেঘনা যে আজ তার জন্মদিন। আর সেই জন্যেই নীলেশ টাকাগুলো দিয়ে গেছিল। সব কথা মনে করে কপালে হাত চাপড়ে গা ঝেড়ে উঠে ডাকাডাকি আর সাজগোজে সে লেগে গেল বটে কিন্তু নীলেশকে ফোন সে করল না।
তার বদ্ধ ধারণা ছিল নীলেশ ঠিক সময়ে নিশ্চয়ই চলে আসবে। গতবারে তো সে নিজেই প্রায় ‘হোস্ট’ হয়েছিল। রাত ন’টা নাগাদ প্রায় সব আমন্ত্রিতদের এসে যাওয়া পর্যন্ত মেঘনার নীলেশের আসার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস ক্ষীণ হতে হতে শূন্যতে এসে যাওয়ায় কেক কাটার পর হাসিঠাট্টা-তামাশার আড়াল হয়ে নীলেশকে বার তিনেক ফোন করে নিষ্ফল হয়ে রাগের চোটেই বোধ হয় ভোদকার গ্লাসটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এসেছিল সে।
* * *
নিজের রক্তচক্ষুর ওপরের ভেজা বাষ্প সামনের দৃশ্যপটকে ঝাপসা করে বাস্তবিক অশ্রুবিন্দু হয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই মেঘনা যেন মানসচক্ষুতে দেখতে পেল দীর্ঘ বছর আগে পেছনে ফেলে আসা স্কুল জীবনের শেষ ভাগের এক চরিত্রকে। নতুন ভর্তি হওয়া ক্লাস টেনের এক ছাত্র। কেমন শান্ত, করুণ চোখদুটো তার যেন এক পলকে অনেক মৌন কথা বলে যেত। আজকাল কেন কে জানে একান্তে ভিড় করে আসা মেঘনার ভাবাবেগের সূক্ষ্ম অন্তরালগুলোর আনাচে কানাচে এই মুখটাই কখনো কখনো অনধিকার প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছিল।
“হোয়াট দ্য হেল, ইয়ার? সবাই মেঘনা-মেঘনা চিল্লাচ্ছে আর তুই এখানে একলা কি মজা নিচ্ছিস বাবা? অনেকদিন হল তোর সাথে সেই বিশেষ একজনের আলাপ করাবো বলেছিলাম না? আজ এসেছে। চল্ না।” কথাগুলো তরতর করে বলে প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল মেঘনাকে তার স্বল্পদিনের এক অভিনেত্রী বান্ধবী পিঙ্কি।
পিঙ্কির একটা কথা ঈর্ষাজনিত বিরক্তির সাথে মেঘনা হজম করলেও মাঝে মাঝে একান্তে ভাবলে তার মনকে ছুঁয়ে যেত। কথাটা হল –‘মরে গেলেও ছোট পর্দায় কাজ করবো না। বড় পর্দায় ছোট রোল করে আমিতো খুশী।’
সত্যিই তো। সে কিছু পাঞ্জাবী আর ভোজপুরী ছবিতে কাজ করেছে। কি একটা বাংলা ছবিতেও কাজ করেছে। তেলেগু ছবিতে আইটেম ড্যান্সও করেছে। কখনো কখনো দুম করে এই সব শোনাতে আরম্ভ করলে মেঘনার ওর ওপর বেশ হিংসেও হতো।
“মীট মাই ফ্রেন্ড বিনি, বিনয় শ্রীবাস্তব। কোরিওগ্রাফার এ্যান্ড এ্যাক্টর। আর বিনি, এ হল আমার বান্ধবী মেঘনা – তোমায় বলেছিলাম না,” শেষ না করে একটু কাঁধ নাড়িয়ে চোখ নাচিয়ে মুচকি হেসে বলল, “টিভি আর্টিস্ট।”
এই টিভি আর্টিস্ট খেতাবটা আর হজম হতে চায় না মেঘনার। শুধু যেন বড় পর্দায় না যেতে পারার ব্যর্থতা মনে এসে যায়। কিন্তু এবার বিনয়কে দেখে ওসব কিছু অনুভূতি হওয়ার আগেই তার বুকের মধ্যে কেমন একটা টান পড়ল। গায়ের রং শ্যামলা হলে কি হবে, পুরো দস্তুর চিত্রতারকা লাগছিল। মজবুত শরীর-সৌষ্ঠব দেখে মেঘনার চোখ যেন আর ফিরছিল না। একি সেই দেবদূত যে তাকে তার স্বপ্নের দুনিয়াতে নিয়ে যাবে?
“কিরে? ফিক্স হয়ে গেলি যে!”
পিঙ্কির টিপ্পনীতে সম্বিৎ ফিরিয়ে এনে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করল মেঘনা বিনয়ের সাথে। আর পিঙ্কি যেন হোস্ট হয়ে দুই অতিথিকে আলাপের সুযোগ দিয়ে অন্যদিকে পা চালাল।
“শুনলাম নতুন একটা হিন্দি ছবিতে কাজ করছেন। কবে শুরু হবে?” বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিককার বার্তালাপের পর মেঘনার প্রশ্ন।
“ব্যস, খুব শীগগিরই হবে। রাইটার এবং প্রোডিউসার আমার বন্ধু। ফাইন্যান্সারের ব্যাপারটা একটু আটকাচ্ছে। সচরাচর আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যা হয়।” অত্যন্ত শান্ত ভাবে সব কথার মোক্ষম শ্রুতিমধুর জবাব দেয় বিনয় মন ছিনিয়ে নেওয়া ছোট ছোট টুকরো হাসির সাথে।
কথার ফাঁকে ফাঁকে কখন যে খাবার খেয়ে এক এক করে প্রায় সব গেস্ট আলবিদা করেছিল তা মেঘনার মাথায় এসেও যেন এল না। সেই সাড়ে ন’টাতে কেক কাটার পর থেকে এই সাড়ে বারোটা পর্যন্ত প্রায় এক বড় বোতল ভোদকা সে একাই উদরস্থ করেছিল। পিঙ্কি আর বিনয় ছাড়া আর একজন শেষ অতিথিকে বিদায় দিয়ে বেশ জড়ানো গলায় নিজেকে দুলিয়ে পিঙ্কিকে ইশারা করে বলে উঠল মেঘনা, “ তুই যাবি না আজ। তোরা দুজনে আজ আমার বিশেষ অতিথি।”
পিঙ্কি তার বিশেষ মদের সঙ্গী হওয়ার দরুন মাঝে মাঝে অতিরিক্ত নেশা চড়িয়ে মেঘনার কাছেই রাত কাটিয়ে দিত। আসলে তাদের মধ্যে মেয়ে-মেয়ে টাইপের ‘লেসবিয়ান’ ব্যাপারটা না থাকলেও পিঙ্কির যেন মেঘনার প্রতি কোথায় একটা বেশ দুর্বলতা ছিল। তাই সে তো পুরো মাথা নাড়িয়ে অস্তর্থক অভিব্যক্তির সাথে চোখ টিপে হাসল।
হলঘর থেকে মেঘনা তার দুই অতিথিকে নিজের বেডরুমে নিয়ে গেল। নতুন একটা বোতল আর রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসা কিছু তাজা স্ন্যাক্সের সাথে আরও দেড় ঘণ্টা কেটে যেতে যেতে বিনয় তার আকর্ষক স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে মেঘনাকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল যে ফাইন্যান্স জোগাড় করে আনতে পারলে সে তার নতুন ছবিটাতে নায়িকার ভূমিকা করতে পারবে কারণ এখন পর্যন্ত নায়িকা নিশ্চিত করেনি প্রডিউসার। যেহেতু পুরো মদের সিংহভাগটা মেঘনা এবং পিঙ্কিই শেষ করেছিল তাই বিনয়ের নেশায় না গুলানো স্পষ্ট কথাগুলো মেঘনার কানের ভেতর দিয়ে মস্তিস্ক হয়ে সোজা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে এক রঙ্গিন স্বপ্নজাল রচনা করে তাকে এক বড় নায়িকার রূপ প্রাপ্ত করিয়ে দিয়েছিল। আর কথার মর্ম বোঝাতে অতি আবেগে পিঙ্কি তাকে বেশ করে ক’বার চিমটি কেটেছিল এবং একবার তার গালে এক বড় সশব্দ চুমু দিয়ে দিয়েছিল যা মেঘনার আপাত স্থিতিতে আদৌ ভালো লেগেছিল না। বরং নিজেকে নায়িকার জায়গায় ভেবে তার পিঙ্কির এই ব্যবহারটা যথেষ্ট বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল। মেঘনার অরুচিকর প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে করতে পিঙ্কি বেচারি তিনটের কিছু আগে তীব্র নেশার ঘোরে খালি গ্লাসটা সমেত বিছানাতে গড়িয়ে পড়েই গভীর নিদ্রামগ্ন হয়ে গেল। আর তার এই অসময়ে আসা নিদ্রাকে সম্মান জানাতে মেঘনা নিজের কণ্ঠস্বর অতি নিম্ন করে বার্তালাপের খেই কেটে তিনটে নাগাদ পাশের বেডরুমটাতে গিয়ে বসার আগ্রহ প্রকাশ করে বিনয়কে ইশারা করাতে সুবোধ বালকের মতো রাজী হয়ে মেঘনার পিছু নিল সে। হলঘরের সেই আবেগপূর্ণ টিমটিমানো লাল নীল সবুজ আলোর মধ্য দিয়ে হয়ে পাশের ঘরের দরজার সামনে এসে বিনয় আসছে কিনা দেখার জন্যে হঠাৎ পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়াতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে আসা বিনয় হুমড়ি খেল প্রায় মেঘনার মুখের ওপর। মেঘনার কোমল বাহুদুটো ধরে নিমেষে নিজেকে সামলে নিয়ে মেঘনাকেও সামাল দিতে নিজের দিকে একটু টান দিতেই মেঘনা পুরোপুরি বিনয়ের বুকের ওপর নেতিয়ে পড়ল।
অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার কিলবিলে পোকা বিদেশী মদের রসে ভিজে মেঘনার অন্তঃমনের পর্দায় লাফ দিয়ে দিয়ে বিগত কয়েক ঘণ্টাতে বিনয়কে নিয়ে বিভিন্ন রঙ্গিন চিত্র বানিয়ে ফেলেছিল। আর এই মুহূর্তের অকস্মাৎ পুরুষ স্পর্শে সেই রঙ্গিন চিত্রগুলো যেন মেঘনার স্বভাবজাত অদমনীয় কাম বাসনার অসংখ্য কীটগুলোকে জাগিয়ে দিল তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
দরজা সে প্রায় খুলেই ফেলেছিল পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়ার আগে। এখন হলঘরের থেকে ছিটকে আসা আলোর রেশ ধরে বেডরুমের আলো না জ্বালিয়েই নড়বড়ে পায়ে বিছানায় গিয়ে টেনে নিল বিনয়কে নিজের ওপর।
আর পর মুহূর্তে উত্তাল আবেগে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের সাথে অনেক পূর্বে কুমারীত্ব বিসর্জন করা মেঘনা যেন নতুন করে কুমারিত্ব অর্জন করে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে বিনয়কে নিজের সর্ব অঙ্গের স্বাদ পাইয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
হোমের জ্বলন্ত আগুনে যেন ঘিয়ের ছিটে দিয়ে দমিয়ে রাখা ভাবাবেগের সাথে বিনয়ও চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় করে উপভোগ করল কৃত্রিম কুমারিত্বের সমস্ত উপকরণগুলিকে আধো-আঁধারী সেই মায়াময় শয়নকক্ষে।
* * *
রাত্রির শেষ প্রহরের সমাপ্তির কিছু আগে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মেঘনা পুরো নেশা জড়ানো খশখশে গলায় ফিসফিসিয়ে বিনয়ের কানের কাছে বলেছিল, “ কমপক্ষে কত লাগবে ফিল্মটার জন্যে?”
ভনিতা এবং ব্যাখ্যাহীন জবাব এসেছিল বিনয়ের, “এক দশ।”
* * *
“এক কোটি দশ লক্ষ কোন ছেলে খেলা নয়।” নীলেশ একটু গম্ভীর হয়েই বলল তার ফার্মহাউসের মখমলি বিছানায় বালিশটা নিয়ে উঠে বসতে বসতে।
“বারে! বিয়ে করবে, বউকে যৌতূক দেবে না? তোমার কাছে এটা কিছু নয়। আর তা যখন আমি তোমার সব শর্তে রাজী হয়ে গেছি।” বেপরোয়া মেঘনা বিয়ের প্রস্তাব স্বীকার করে নীলেশের সাথে রাত কাটিয়ে সরল করে জবাবী টিপ্পনী করল। “ভালো একটা গাড়ী দিলেও তো ষাট সত্তর লেগেই যাবে। তা তো চাইছি না। আর কয়েকটা টাকা তার সাথে যোগ করে না হয়, আমার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করলে।”
“ঠিক আছে, এক দেবো। যখন চাই, দুদিন আগে বলবে। কিন্তু কথা দাও এরকম জেদ আর কখনো করবে না।” নীলেশের সৈদ্ধান্তিক মন থেকে বেরিয়ে আসা এই প্রচ্ছন্ন জবাবে অতি সন্তুষ্ট হয়ে মেঘনা একবার অস্তর্থক আর একবার নস্তর্থক ভাবে মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বিনয়ের খোলা বুকে চুমু খেয়ে শিশির ভেজা ভোরের বাতাসে রাতের মিইয়ে আসা আবেগকে পুনঃসঞ্চার করে তাকে সশক্ত বাহুপাশে বেঁধে গড়িয়ে পড়ল আবার বাসি বিছানার ওপর।
* * *
বিনয়ের সাথে একটু আনাকানি করে দশ লক্ষ ছাড় করিয়ে এক কোটিতে পাকা কথা করে পাঁচ দিন পরে রাতের বেলা বিনয়কে ফোন করে ডাকাতে সটান চলে এসে সে বলল, “আজকে তো পার্টী হওয়া চাই। সকালে আমি তোমায় প্রোডিউসারের কাছে নিয়ে যাবো।”
নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন পুরো হতে চলেছে অনুভব করে খুশীতে গদগদ হয়ে বিছানার ওপর ট্রে রেখে নীলেশের দেওয়া বড় একটা সিঙ্গল মল্ট স্কচের বোতল খুলে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে মেঘনা বলল, “আজ একটু স্ট্রং হয়ে যাক।”
রাত আড়াইটের দিকে দ্বিতীয় বোতলের বেশীর ভাগই মেঘনা নিজে উদরস্থ করে এ.সি.র ঠাণ্ডা বাড়িয়ে দিয়ে লাইট বন্দ করে চাদর মুড়ি দিয়ে যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন হল তখন তার সম্পূর্ণ নগ্ন নির্বস্ত্র সুডৌল শরীরের ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিজের হাত সরিয়ে নিল সমরুপ নির্বস্ত্র বিনয় উরফ বিনি।
* * *
“ফিল্ম টিল্ম আর তোমায় করতে হবে না। আর ডাক্তার বলেছে মদ তোমার কাছে বিষ। কেন শুনছো না? তার ওপর সমাজ বলে একটা জিনিষ রয়েছে কি না? দ্যাখ, বার বার বলছি, যা হয়েছে সব ভুলে যাও। নতুন যে আসছে তার কথা ভাবো।”
নীলেশের এই সান্ত্বনা এবং উপদেশ মূলক উক্তির জবাবে তার সদ্য বিবাহিতা একমাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মেঘু ঝাঁঝিয়ে উঠল নেশা ভরা কণ্ঠে, “তোমরা পুরুষরা শুধুই নিজের কথাই বলতে চাও। আরে, ভোলারই তো চেষ্টা করছি আর তা তুমি বার বার মনে করাচ্ছ মানা করার সুর তুলে।”
সত্যিই তো, জীবনের সমস্ত স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া অমন ঘটনা সহজে ভোলা যায় না।
সেদিন সকালে অনেক বেলায় জেগে উঠে মেঘনা বিনিকে বিছানায় না পেয়ে তাড়াতাড়ি নগ্ন শরীরকে পোশাকে ঢেকে গোটা ফ্ল্যাট ঘুরে শেষ কালে আলমারিটা খুলে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল টাকার ব্যাগটা না দেখে।
নীলেশ ফোন পেয়ে সিগন্যাল না মেনে কোটি টাকার অডি গাড়ী উড়িয়ে নিয়ে এসে জেনেছিল শব্দ কম করার জন্যে দরজার অটো লকে চুলে লাগানো তেল দিয়ে আলতো টেনে দরজাটাকে বন্ধ করে টাকার ব্যাগ শুদ্ধ হাওয়া হয়েছিল বিনয়। কালো টাকা ছিল বলে নীলেশ কোথাও কাউকে খবর করতে পেরেছিল না। দিন কুড়ি পরে মদে ডুবে যাওয়া মেঘনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ব্যাপার জেনে ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে তাকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে এনেছিল নীলেশ।
কার থেকে কি হয়ে গেল! মেঘনা তো বোধহয় ভেবেছিল বিনয়ের মতই পুষ্ট একটা ছেলে সে পেয়ে যাবে যার বাবা হবে নীলেশ আর সম্পূর্ণ শারীরিক সুখ সে নেবে বিনির কাছ থেকে। একেই বোধ হয় ইংরেজি প্রবাদে বলে, ‘ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস’ – মানুষ যতোই পরিকল্পনা করুক না কেন ভগবান তার নিজের হিসেবেই ফল দেয়।
* * *
মাস পাঁচেক আরও কাটার পর হঠাৎ এক দিন টিভি চ্যানেল বদলাতে বদলাতে একটা নিউজ চ্যানেলে মেঘনার নজরে পড়ল বিনয়ের মতো একটা মুখ।
মতো নয়। শীর্ণকায় অবয়বে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটা সত্যিই ছিল বিনয়। ফলাও করে তুলে ধরা কাহিনী শুনে মেঘনার মনে এল এক শান্তি – যেন প্রতিশোধ নিয়ে নেওয়ার শান্তি।
খবরে বলছিল কোন এক সদস্যতাহীন অজানা ডিরেক্টরের সাথে মিলে দু-দুটো নতুন পঞ্জীকৃত সিনেমা কোম্পানির থেকে মোটা টাকা আত্মসাৎ করেছিল এই বিনয়। তারপর ডিরেক্টর নাকি চোরের ওপর বাটপাড়ি করে সব পয়সা নিয়ে এখনও উধাও। কোন এক এন.জি.ও. র লোকেরা অন্য এডস রোগীদের সাথে একেও ভর্তি করে গেছে এই হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসা সুবিধার জন্যে। অভাগা বিনয়ের এখন শেষ অবস্থা। তাই জেল কর্তৃপক্ষ তাকে ছেড়ে দিয়েছিল এন.জি.ও.র হাতে সম্ভাব্য সুচিকিৎসার জন্যে। মাত্র কয়েক মাস আগের বলিষ্ঠ সেই বিনয়ের অতি শীর্ণ কালো পড়ে যাওয়া মুখের ওপর কোটরাগত চোখদুটো সম্পূর্ণ নিষ্প্রভ। শ্বাস টেনে টেনে ক্ষমা প্রার্থনা করছিল সে তার নিজকৃত্যের জন্যে। আর দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলছিল শারীরিক সম্বন্ধের পূর্বে অতি সতর্কতার সাথে সাথে মেডিক্যাল চেক-আপ অত্যন্ত জরুরী। ডাক্তারের সুনিশ্চিত করা তার জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে সে নিজের পাপমুক্তির প্রার্থনা করে কেঁদে ফেলল।
মেঘনার শান্তি উত্তেজনায় পরিণত হয়ে তার বিনয়ের সাথে সেই দুই রাতের অসুরক্ষিত সম্ভোগের দৃশ্যপটে রূপান্তরিত হয়ে গেল। হাত থেকে খসে পড়ল রিমোটটা। মৃতবৎ আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া তার শরীরের ভেতর কেমন অসহ্য এক অনুভূতির সাথে গা ঘিনিয়ে – মাথা ঘুরিয়ে বমি ভাব আসল। টিভির বাক্যগুলো যেন অতি অবোধ্য ধ্বনিমাত্র হয়ে গোটা ঘরে উচ্চনাদে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ছুটে বাথরুমের কাছে পৌঁছুতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা নীলেশের চোখে পড়ল তার আদুরে মেঘুর এই দুর্দশা। তার “কি হয়েছে, মেঘু?” প্রশ্নের জবাব মেঘনার বমি হয়ে হড়হড়িয়ে বেরিয়ে এল বাথরুমের সামনের ওয়াশ বেসিনটাতে। আর পর মুহূর্তে বমির কারণে জল ভরে আসা তার চোখদুটো থেকে সত্যিকারের গভীর দুঃখের বাঁধভাঙ্গা অশ্রু ঝরতে দেখে নীলেশ তাকে সোফাতে বসাতেই ছোট বাচ্চার মতো ফুফিয়ে কেঁদে নীলেশকে জড়িয়ে ধরে টিভির দিকে হাত দেখাল।
ছোট একটা বিজ্ঞাপনের পরে চলছিল বিনয়ের জেলে অসুস্থ হওয়ার কাহিনী। যে অফিসার তাকে ধরেছিল, যে এন.জি.ও. তাকে নিয়ে এসেছিল তাদের ইন্টার্ভিউ ক্লিপ্স আর মাঝে মাঝে বিনয়ের মুখভঙ্গির সাথে তার কথাগুলো লিখে আসছিল পর্দার ওপর হিন্দিতে।
বিস্মিত নীলেশের কৌতূহলী দৃষ্টির জবাবে, আসন্ন মৃত্যুভয়ে এবং অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় অকপটে বলে ফেলল মেঘনা তার সেই দুই কালরাত্রির কথা।
অতি উদবিগ্নতায় এবং হৃদয় বিদারক অনুভূতির সাথে দুজনেই নিজেদের পরীক্ষা করাতে এইচ.আই.ভি. পজিটিভ রিপোর্ট এল দুজনেরই। সেই দিন গভীর রাতে হৃদয়ের মধ্যে মুহুর্মুহু অসহ্য যন্ত্রণা হতে হতে ডাক্তারের পৌঁছুনোর আগেই মারা গেল নীলেশ।
ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেঘনার অত্যধিক মদ্যপান এবং প্রচণ্ড মানসিক উৎপীড়নের কারণে জোরালো অসুস্থ হয়ে পড়ার দরুন তার গর্ভপাত হল মাত্র এক সপ্তাহের পর।
* * *
আট মাস পরে পরিজন হীন হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িতা মেঘনার নিজের ব্যাক্তিগত জীবন দর্শনের প্রতিচ্ছবিগুলোকে পর্যালোচনা করতে করতে ঝাপসা হয়ে আসা চোখের শূন্যদৃষ্টির গভীরে বার বার ভেসে উঠেছিল ক্লাস টেনের সেই মুখটা। কি নাম ছিল যেন? হ্যাঁ – প্রকাশ।
তারপর সমস্ত চেতনা শক্তির বিলোপ হওয়ার সাথে সাথে সর্ব শরীর যন্ত্রণাহীন হয়ে শিথিল হয়ে যাওয়ার আগে তার মনে হয়েছিল – তার কৃত্য উচিত অনুচিত সব কিছুই প্রায় সঠিকভাবে পরাবর্তিত হয়েছে তার জীবনে। কিন্তু হয়নি শুধু সেই করুণ মুখটার ভাসা ভাসা চোখদুটো থেকে ছড়িয়ে পড়া অব্যক্ত প্রাঞ্জল ভালোবাসার পরাবর্তন।
সমাপ্ত
এ. আর. সরকার